একটি ভালো নির্বাচন দেশে ভালো গণতন্ত্র দিতে পারে, নাকি ভালো গণতন্ত্র একটি ভালো নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে, এ বিতর্ক নতুন নয়। তবে এ কথা বিতর্কের ঊর্ধ্বে যে, গেলো তিনটি নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিক সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং বিগত সরকারের মসনদ পাকাপোক্ত করতে নির্বাচন ব্যবস্থাকেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দুর্বল করে দেয়া হয়েছিলো। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে বটে; কিন্তু যারা নেপথ্যে অপশাসনের কুশীলব হিসাবে কাজ করেছেন, তাদের অনেকেই রয়েছেন বহাল তবিয়তে। গণমাধ্যমে খবরে প্রকাশ, তিনটি নির্বাচনে বিগত সরকারকে টানা জয় এনে দেয়ার ক্ষেত্রে মূল কারিগর সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা প্রত্যেকেই ঢাকায় নিজ বাসাতেই অবস্থান করছেন। যদিও গতকাল রোবাবর সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাকে আটক করেছে পুলিশ। বিকেলে উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টর এলাকায় তার বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। যাদের সহায়তায় একের পর এক জয় পেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন, তারা অকেনেই এখন পর্যন্ত অধরাই রয়েছেন। জানা গেছে, ‘বিতর্কিত তিন জাতীয় নির্বাচন’ আয়োজনে জড়িতদের ভূমিকা তদন্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘একতরফা বিনা ভোটের’ নির্বাচন আয়োজনের অন্যতম কারিগর তৎকালীন সিইসি বারিধারায় নিজ বাসভবনে রয়েছেন। এছাড়া ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘রাতের ভোটে’র অন্যতম কারিগরও রয়েছেন উত্তরায় নিজ বাসাতেই ছিলেন। বই লিখে সময় কাটাচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি পুলিশ তাকে আটক করে। আর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘আমি-ডামি’ ভোটের কারিগর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দিন কাটছে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিভৃতে। এদিকে, ওই তিন নির্বাচন কমিশনের বেশির ভাগ নির্বাচন কমিশনারও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও যেমন গ্রেফতার হননি, তাদেরকে সহযোগিতা করা অতি উৎসাহী নির্বাচন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও তেমনি নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কম-বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তবে বিগত সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন যে সব অনিয়ম ও কারচুপিকে ছাড়িয়ে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনগুলো ছিল চরম বিতর্কিত। নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে তিনবারই ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। ওই তিন নির্বাচন কমিশনের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের ভূমিকার কারণেই টানা জয়ে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা অমূলক মনে করার কারণ নেই। আমরা দেখেছি, ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও নির্বাচন আয়োজন ও তা সম্পন্নে কমিশনের সঙ্গে জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় আইন সংশোধন করে ইসিকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলো। সুষ্ঠু ভোট সম্পন্নে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের নিষ্ক্রিয় করার পেছনে যে শুভ উদ্দেশ্য ছিলো না, তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্রকামী মানুষের বিপরীতে যারা কাজ করেছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.