কাতার ও ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বিশ্বজুড়ে মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা জারি

স্টাফ রিপোর্টার: সর্বাত্মক যুদ্ধে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরাইলের সংঘাত। ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে মার্কিন হামলার জবাব ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দিল ইরান। গতকাল সোমবার রাতে একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার ও ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল তেহরান। হামলার পরপরই দেয়া বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ খবর নিশ্চিত করেছে দেশটির ইসলামী বিপ্লবী বাহিনী (আইআরজিসি)। জানিয়েছে, কাতারে অবস্থিত মার্কিন আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেই অবশ্য ইরাকের এরবিল সামরিক ঘাঁটিতে হাই অ্যালার্ট জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এর আগে সন্ধ্যায় বিস্ফোরণ আর সাইরেনের শব্দে কেঁপে ওঠে ইসরাইলের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। প্রথমবার বহু মাথাবিশিষ্ট ‘খাইবার’ ব্যালিস্টিক মিসাইল (কদর-এইচ) ছুড়ে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি)। সঙ্গে ছিল অত্যাধুনিক স্মার্ট ড্রোন ও শক্তিশালী হামলার কৌশল। এ হামলার সামনে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। রাজধানী থেকে উপকূল, সামরিক ঘাঁটি থেকে বেসামরিক অবকাঠামো-কোনো কিছুই আর নিরাপদ নয় ইসরাইলে। ইরান স্পষ্ট করে দিয়েছে-প্রতিশোধের আগুন এখনই নেভবে না, বরং আরও ছড়িয়ে পড়বে, যতক্ষণ না দখলদারির শেষ কণাও ধ্বংস হয়।
১৩ জুন ইরানে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে শত শত নিরীহ নাগরিক, শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে বর্বর ইসরাইলি বাহিনী। তখন থেকেই ইরানে শুরু হয় প্রতিরোধের প্রস্তুতি, যা চলছেই। ইসরাইলি আগ্রাসনের পালটা জবাবে এবার আরও একধাপ এগিয়ে গেল তেহরান। আইআরজিসি জানিয়েছে, সোমবার ইসরাইলি ভূখ- লক্ষ্য করে প্রথমবার বহু মাথাযুক্ত ‘খাইবার’ ব্যালিস্টিক মিসাইল (‘কদর-এইচ’) ছোড়া হয়েছে। এ ছিল ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি’ অভিযানের ২১তম ধাপ। এতে একযোগে কঠিন ও তরল জ্বালানিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি এমন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, যা ইসরাইলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম। একই সময়ে ইরানের পরপর ৮টি খাইবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দক্ষিণ ইসরাইলের বেশ কয়েকটি শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। ইরানের প্রতিরোধ অভিযানের মুখপাত্র ইব্রাহিম জোলফাঘারি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘জুয়াড়ি ট্রাম্প, তুমি যুদ্ধ শুরু করেছ, কিন্তু শেষটা আমাদের হাতে।’ মৃতপ্রায় ইসরাইলকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি। ইসরাইলের ‘উগ্র, বেপরোয়া ও খাপছাড়া কর্মকা-’ ঠেকাতে ইরান কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং প্রয়োজনে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সাঈদ খাতিবজাদে। ইরানের পালটা হামলার মধ্যেই ইসরাইলে আরেক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথিও। রাজধানী তেল আবিব লক্ষ্য করে ছোড়া হয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। তবে সেটিকে সফলভাবে প্রতিহতের দাবি করছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কিছুক্ষণ পরই ইসরাইল তেহরানসহ ইরানের আরও বেশ কয়েকটি শহরে পালটা হামলা চালিয়েছে। আলজাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিম তেহরানের অধ্যাপক ফোয়াদ ইজাদি জানিয়েছেন, একটি হাসপাতালের পাশে ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে এবং ঘটনাস্থলে ধোঁয়া দেখা গেছে। এছাড়া ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা ইরানের পশ্চিম, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত কমপক্ষে ছয়টি বিমানবন্দরে বিমান হামলা চালিয়েছে। রোববার রাতে ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালানোর খবর দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এর মাত্র একদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় এ কেন্দ্রটি লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল। ফোর্দো ছাড়াও আরও দুটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ হামলার ‘কঠিন জবাব’ দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল আমির হাতামি। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে নিজেদের নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক করে একটি বিবৃতি দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। কাতারে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে থাকার পরামর্শ দিয়েছে দেশটির মার্কিন দূতাবাস। এক ইমেইল বার্তায় দূতাবাস জানিয়েছে, ‘সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে’ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। এদিকে এই উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘সরকার পরিবর্তন (রেজিম চেঞ্জ) শব্দটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। কিন্তু ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থা যদি দেশটিকে আবার মহান করতে না পারে, তাহলে কেনই বা সরকার পরিবর্তন হবে না? মিগা (‘মেক ইরান গ্রেট অ্যাগেইন’ বোঝানো হয়েছে)। স্থানীয় সময় রোববার বিকাল ৫টার দিকে নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে এই কথা জানান তিনি। অথচ কদিন আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখা, সরকার পরিবর্তন নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে ইরানের দূত আমির সাইদ ইরাভানি বলেছেন, ইরানের প্রতিরোধের সময়, প্রকৃতি এবং মাত্রা নির্ধারণ করবে সশস্ত্র বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর চাপেই যুক্তরাষ্ট্র ‘অযথা ও ব্যয়বহুল’ যুদ্ধে জড়িয়েছে।
এদিকে সোমবার সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হাসাকাহ প্রদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর একটি ঘাঁটিতে মর্টার হামলার ঘটনা ঘটেছ। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা মেহের নিউজ এ খবর নিশ্চিত করেছে। হামলার পর ওই ঘাঁটিতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তবে কারা হামলা চালিয়েছে, বিষয়টি এখনো জানা যায়নি।
ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেলের প্রস্তাব দিয়ে পরদিন হামলার নিন্দা পাকিস্তানের : ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু এর মাত্র একদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় বোমা বর্ষণের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। এই সংকটের একমাত্র সমাধান কূটনীতি।’

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More