দর্শনার কেরুজ এমডির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য বদলিসহ নানা অভিযোগ দুর্নীতি ও অনিয়মের মহোৎসব : স্মরণকালের লোকসানের পথে চিনিকল ও ডিস্টিলারি বিভাগ
স্টাফ রিপোটার: দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেড, যা চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত, বর্তমানে দুর্নীতি, অনিয়ম, জবাবদিহিহীনতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের আখড়াতে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর রাব্বিক হাসান-এর বিরুদ্ধে ওঠা বিস্তর অভিযোগ ঘুরছে সংশ্লিষ্ট মহলে। আর এতে কেরুজ চিনিকল ও ডিস্টিলারি বিভাগে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোকসানের সম্ভাবনার পথে রয়েছে। অস্থায়ী লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে, তেমনি বদলি, বাংলা মদ বোতলজাতকরণ ও কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও ব্যাপক সমলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর রাব্বিক হাসান। দুর্নীতি ও অনিয়মের মহাৎসবে মেতে ক্ষণে ক্ষণে নিজের ভোল পাল্টিয়ে স্বৈরাচারী কর্মকা-ে নিজেকে অধিষ্ট করে তুলেছেন। শ্রমিক নেতৃবৃন্দসহ শ্রমিক-কর্মচারীরা দিনদিন ফুসছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর। কেরুজ চিনিকলের ডিস্টিলারি বিভাগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে ১৩টি বন্ডেড ওয়ার হাউজ (বাংলা মদ বিক্রয় কেন্দ্র)। চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে বেশ কয়েকটা ওয়ার হাউজের ইনচার্জকে অন্যত্র মিলে বদলি ঘটনায় নানামুখি অভিযোগ উঠেছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসানের বিরুদ্ধে। ঢাকা ওয়্যার হাউজে হারুন অর রশিদকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া হারুন অর রশিদ চিনিকলের একটি ফার্মে দায়িত্ব পালনকালে গাছ চুরির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে সময় সৌমিক হাসান রুপমের কাছে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দাবি করলে তা না দেয়ায় সেখানে হারুন অর রশিদকে পদস্থ করা হয় বলেও উঠেছে অভিযোগ। রুপমের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে কেরুজ চিনিকল থেকে পঞ্চগড় বন্ধ সুগার মিলে বদলি করা হয়। রুপম কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের জনপ্রিয় সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। আব্দুল্লাহ মামুনের কাছে তৎকালীন করপোরোশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্রকে দেয়ার জন্যও ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন রাব্বিক হাসান। মামুনের অভিযোগ সে টাকা দিতে মুখের ওপর অস্বিকৃতি জানালে তাকে তার পদের তিনধাপ ডিমোশন দিয়ে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে বদলি করা হয়। যা নিয়ে মামুন আইনিভাবে লড়ছেন। দেলোয়ার হোসেনকে বরিশাল ওয়ার হাউজ থেকে নাটোর সুগার মিলে, আলমগীর হোসেনকে পাবনা থেকে নাটেরের গোপালপুর সুগার মিলে, গোডাউন ইনচার্জ সাজেদুর রহমান তুফানকে ঠাকুরগাঁও সুগার এবং এজাজ আহমেদ বাপ্পিকে জিল বাংলা সুগার মিলে বদলি করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গল ওয়ার হাউজের ইনচার্জ পদে জাহাঙ্গীর আলম, বরিশাল হাউজে মহিউদ্দিন, পাবনা হাউজে ইমতিয়াজুর রহমান ও পারবর্তিপুরের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া রাশিদুল ইসলামকে নিয়েও ব্যাপক সমলোচনা রয়েছে। প্রত্যেককে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিমিয়ে পদায়ন করা হলেও চরম ক্ষতির মুখে ডিস্টিলারি বিভাগ। অভিযোগ উঠেছে, শ্রীমঙ্গলে জাহাঙ্গীর আলম পরিচালনায় ব্যার্থ। জানুয়ারির শুরুর দিকে যখন রুপমকে বদলি করা হয়, তখন কেরুজ এলাকায় আন্দোলনে মাঠে নামে শ্রমিক-কর্মচারী। সে ঝড়-ঝাপটায় কৌশলে রাশিদুলকে পদস্থ করা হয় পারবর্তীপুর হাউজে। ফলে ওই হাউজের সার্বিক দেখভাল করে থাকেন বহিরাগত শাহনেওয়াজ শাহীন। এছাড়া ঢাকা, পারবর্তীপুর, বরিশাল ও পাবনায় সাবেক কোন কোন ইনচার্জকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করিয়ে নিচ্ছেন বর্তমান অযোগ্য ইনচার্জরা। সাবেক চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্রের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন রাব্বিক হাসান। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতিপূর্বে কেরুজ চিনিকলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা ছিলেন, তারা মাঠ পর্যাায়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কথা বলতেন। চাষিদের সুবিধা-অসুবিধাসহ প্রয়োজনীয় অভিযোগ-অনুযোগ শুনতেন। সে মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহন করতেন। ফলে আখচাষিরা হতেন আন্তরিক। উদ্বুদ্ধ হয়ে আখচাষের দিকেও ঝুকতেন। অভিযোগ উঠেছে, মীর রাব্বিক হাসান দায়িত্ব গ্রহনের পর নিয়মিত অফিস করলেও বসে থাকেন ঠান্ডা ঘরে। চাষিদের কাছে যেমন ঠিক মতো যাননা, তেমনি চাষিরা তার অফিসে গেলেও তিনি সাক্ষাতের সুযোগ দেননা নানা অজুহাতে। ফলে আখচাষিদের সাথে বেড়েছে তার দূরত্ব। যে কারণে ব্যাপক হারে চলতি ইক্ষুরোপণ কমেছে। আগামী আখ মাড়াই মরসুম অনেকটাই হুমকির মুখে। এদিকে করপোরেশনের বিনা অনুমতিতে রাব্বিক হাসানের বিরুদ্ধে গত আখ মাড়াই মরসুমে ৬২জনকে চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগও রয়েছে জনপ্রতি মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। আখচাষী সামসুল হক বলেন, অনেক আগে থেকেই আমি আখ চাষ করে কেরুজ চিনিকলে সরবরাহ করতাম। কিন্তু নতুন এমডি আসার পর আমাকে বাদ দিয়ে নতুন চাষি নির্ধারণ করেছেন। অথচ আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করেননি। এ কারণে আমি না শুধু, আমার মতো আরও অনেক কৃষক আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছে। কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচন প্রতিষ্ঠার সর্বকালের রেকর্ড ভাঙার পেছনেও রাব্বিক হাসান দায়ী বলেও উঠেছে অভিযোগ। তিনি হরেক রকম কায়দা-কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচন স্থগিত রাখার নেপথ্যে ভূমিকা রেখে চলেছেন। যে কারণে শ্রমিকরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে যেমন রয়েছেন বঞ্চিত, তেমনি ন্যায্য অধিকার থেকে পিছিয়েছে। ডিস্টিলারি বিভাগের অবস্থাও নড়বড়ে। চলতি অর্থ বছরের শেষদিন অবধি ফরেন লিকার ও বাংলা মদের উৎপাদনে রয়েছে ব্যাপক ফারাক। গত অর্থ বছরে ২ লাখ ৩২ হাজার কার্টূন ফরেন লিকার বিক্রি হলেও এ অর্থ বছরে হয়েছে ২ লাখ কার্টুন। ৩২ হাজার কার্টুন কম বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া স্প্রিরিট গত অর্থ বছরে ৬০ লাখ ২৮ হাজার প্রুফ লিটার উৎপাদন হলেও এ অর্থ বছরে হয়েছে মাত্র ৪৬ লাখ প্রুফ লিটার। স্প্রিরিট ও ফরেন লিকার উৎপাদন ও বিক্রি পরিমান অনেকাংশে কম হওয়া মুনাফা অর্জনও কমবে বহু টাকা। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অদক্ষতা, অদুরদর্শিতা ও আন্তরিকতার ঘাটতির অভাবেই এমন দশা বলে জানিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারিদের অনেকেই। রাব্বিক হাসানের বিরুদ্ধে বাংলা মদ বোতলজাত করণে গোপন টেন্ডারে ৪০ লাখ প্লাস্টিক বোতল কিনেছেন। যার প্রতি পিস বোতলের মূল্য ধরা হয়েছে ১৪ টাকা হারে। ক্রয়কৃত বোতলের বাজার মূল্য প্রতি পিস ৭ টাকা বলেও রয়েছে গুঞ্জন। ফলে অতিরিক্ত টাকা কার পকেটে ঢুকলো ? মাস দেড়েক ধরে প্রতিটি ওয়ার হাউজে বোতলজাতকৃত বাংলা মদ দেয়া হলেও তা হচ্ছেনা বেচাবিক্রি। এমনিতেই গত অর্থ বছরের তুলনায় এবার বহুগুনে কম উৎপাদন ও বিক্রি হয়েছে মদ। সেক্ষেত্রে চলতি অর্থ বছরে ডিস্টিলারি মুনাফা কমতে পারে বহু টাকা। মুখ থুবড়ে পরতে পারে ডিস্টিলারি উৎপাদন কার্যক্রম। সম্প্রতি ১০০০ ও ৫০০ এমএল দেশীয় মদ বোতলজাতকরণ ব্যবস্থা ডিএনসি থেকে পেশী শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অনুমোদন নেয়া হলেও বোতলিং লাইসেন্স আনতে পারেনি এখনো। এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদশে) লিমিটেড। এটি একটি সমন্বতি কারখানা। এখানে চিনি, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানটিাইজারসহ বিভিন্ন ধরণের স্পিরিট ও দেশি-বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। কারখানার মূলপণ্য চিনি হলেও কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রাখছে ডিস্টিলারি পণ্য মদ। এ ব্যাপারে কেরুজ ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান জানিয়েছেন, কোনো অভিযোগই সঠিক নয়। সৎ ও ন্যায়-নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন করছি বিধায় খারাপ শ্রেণির মানুষেরা আমার বিরুদ্ধে অপ-প্রচারে মেতেছে। আমি কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকলে সদর দপ্তর উচ্চতর তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে দেখুক। তাছাড়া অন্যত্র মিলে বদলি ও ওয়ার হাউজের পদস্থের বিষয়টি সদর দপ্তর থেকে করা হয়েছে। সেখানে আমার কোনো হাত নেই।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.