মানবপাচার চক্রের লিবিয়ার মাফিয়া সাগরের অন্যতম সহযোগী আলমডাঙ্গার বেলগাছির জীম বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: মানবপাচার চক্রের লিবিয়ার মাফিয়া সাগরের অন্যতম সহযোগী আলমডাঙ্গার বেলগাছি গ্রামের জীমকে কম্বডিয়ায় পালানোর সময় বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার জীম গোপনে কম্বডিয়ায় যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যায়। আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ সংবাদ পেয়ে হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানবন্দর থানা পুলিশের সহযোগিতায় গ্রেফতার করে নিয়ে আসে জীমকে।
জানা গেছে, আলমডাঙ্গার বেলগাছি গ্রামের সাগর ও জীমের বিরুদ্ধে এলাকার বেশ কিছু নিরীহ যুবককে ইতালি নিয়ে যাবার কথা বলে না পাঠিয়ে প্রতারণা করার অভিযোগ উঠে। ভুক্তভোগী যুবকদের লিবিয়ায় আটকিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। ওই অমানবিক নির্যাতন ভিডিও কলে দেশে স্বজনদের দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছে লিবিয়ার মাফিয়া বেলগাছির সাগর। নির্মম এ নির্যাতনের ভিডিও দেখে স্বজনরা হয়ে পড়েছেন উদ্বিগ্ন। এ সকল যুবকদের মধ্যে বেশির ভাগ যুবকের বাড়ি উপজেলার খেজুরতলা গ্রামে। এ ঘটনায় খেজুরতলা গ্রামের ভুক্তভোগীদের পরিবার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। গত ১৪ মে মোবাইল ফোনে জানানো হয়, খেজুরতলা গ্রামের জুনায়েদ হোসের প্লাবন লিবিয়ার মাফিয়াদের নির্যাতনে মারা গেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আলমডাঙ্গার বেলগাছি গ্রামের জান্টু মেম্বারের ছেলে সাগর লিবিয়ার মানব পাচার চক্রের মাফিয়া। এলাকার যুবকদের ইতালি পাঠালে মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি পাবে বলে জানায়। বিনিময়ে প্রত্যেককে ১৩ লাখ টাকা দিতে হবে। এই টাকার বিনিময়ে তাদের দুবাই থেকে ইতালি পাঠানো হবে বলে জানায়। সাগরের কথায় তার চাচাতো ভাই জীম ও চাচি বেদানা খাতুন, বজলুর রহমানের ছেলে সবুজের মাধ্যমে হাউসপুর গ্রামের আতিয়ার রহমানের ছেলে মামুনুর রশিদ, খেজুরতলা গ্রামের তামসের আলীর ছেলে মিঠুন, একই গ্রামের রেজাউল হকের ছেলে তুহিন হক, আব্দুল মজিদের ছেলে তিতাস, আজগর আলীর ছেলে জুয়েল রানা, সাজাহান আলীর ছেলে হাসিবুল ইসলাম, তমেজ আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম, হাসান মন্ডলের ছেলে বকুল হোসেন, শওকত আলীর ছেলে নয়ন হক, ফারুক হোসেনের ছেলে আবু সাঈদ, জমসেদ আলীর ছেলে জুনায়েদ হাসান প্লাবন, আল মামুনের ছেলে আবু জাফর, মহাবুল হোসেনের ছেলে সাগর আলী, মনির উদ্দিন মন্ডলের ছেলে মিল্টন আলী, অহিদুল ইসলামের ছেলে মোশারফ আলী, নজরুল ইসলামের ছেলে বিপুল হোসেন, নাসির উদ্দিনের ছেলে নিশান মিয়া, আনিছ আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ জাহিদ, আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার গোবিন্দপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে সজিব হোসেন, ফজলুর রহমানের ছেলে হৃদয় আহমেদ টিটন, জহুরুল নগরের লাল্টু রহমানের ছেলে সবুজ আলী, কাবিলনগর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে বিপ্লব হোসেন, ঘোলদাড়ি গ্রামের শ্রী চিত্তরঞ্জনের ছেলে শ্রী সনজিত কুমার, কেশবপুর গ্রামের মাহাবুল ইসলামের ছেলে মামুন আলী, চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার মোমিনপুর গ্রামের সমীর আলীর ছেলে তরিকুল ইসলামসহ বেশকিছু যুবক বিদেশে যায়। বিভিন্ন তারিখে নগদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে। প্রথমে তাদেরকে দুবাই নিয়ে যায়। দুবাই থেকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা প্রতারণা করে দুবাই থেকে লিবিয়া নিয়ে যায়। লিবিয়াতে নিয়ে গিয়ে একটি গোপন কক্ষে আটকিয়ে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় শারীরিক নির্যাতন করে। লিবিয়ায় অমানবিক নির্যাতনের ভিডিও মোবাইলের মাধ্যেমে দেশে এসব যুবকদের স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে। টাকা নেয়ার পরও তারা ওই সব যুবকদের সেখানে আটকিয়ে রেখে জনপ্রতি আরও ২২ লাখ টাকা দাবি করছে। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী যুবকদের স্বজনরা মোবাইলে এ দৃশ্য দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা না পাচ্ছেন টাকা পাঠাতে না পারছেন সেখান থেকে তাদের মুক্ত করতে। কোন উপায় না পেয়ে সঠিক পথ খুঁজে পেতে ও বিচারের আশায় অনেকে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর তাদের নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় সাগর। আরও টাকা দাবি করতে থাকে। সাগরের চাচাতো ভাই জীম তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে গিয়ে মামলা করার অপরাধে খেজুরতলা গ্রামের বেশ কয়েকজনকে মারধর করে। এরই মাঝে গত ১৪ মে বুধবার লিবিয়া থেকে ফোনে জানানো হয়, প্রায় দেড় বছর ধরে আটকে রাখা এবং নির্যাতনের মুখে প্লাবনের মৃত্যু হয়েছে। জুনায়েদ হাসান প্লাবন নাগদাহ ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের কৃষক জমসেদ আলীর ছেলে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দেড় বছর আগে বেলগাছি গ্রামের সাগর (লিবিয়ার মাফিয়া) নামে এক দালালের মাধ্যমে প্লাবনকে ইতালি পাঠানোর চুক্তি হয়। বলা হয়েছিল, প্রথমে লিবিয়া, সেখান থেকে সাগর পথে পৌঁছে দেয়া হবে স্বপ্নের দেশে। সেই চুক্তির আড়ালে ছিল ভয়াবহ প্রতারণা। সাগরের চাচাতো ভাই জীমের মাধ্যমে দফায় দফায় ৪০ লাখ টাকারও বেশি পাঠানো হয়। ছেলেকে ফিরে পেতে শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন বাবা জমসেদ আলী। কিন্তু কিছুতেই মুক্তি মেলেনি। বরং মারধরের ভিডিও পাঠিয়ে আরও টাকা আদায়ের চেষ্টা চলতে থাকে।
প্লাবনের বড় বোন স্বপ্না খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘দেড় বছর আগে সাগর ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলাম ভাইটারে। জীম এসে এসে টাকা নিতো। আমরা ভিডিও দেখে কাঁদতাম, আর টাকা দিতাম। শুনেছি, ভাইরে বিক্রি করে দিয়েছে আরেক দালালের কাছে। দুইমাস ধরে মারছে, শেষমেশ মেরে ফেলছে।’ এ ঘটনায় প্লাবনের পরিবার আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। দুটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি বেলগাছি গ্রামের শরিফুল ইসলাম ঠান্ডুর ছেলে জোবায়ের আহমেদ জীম (২৩) কম্বডিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার জন্য হযরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আলমডাঙ্গা থানা অফিসার ইনচার্জ মাসুদুর রহমান (পিপিএম)’র নেতেৃত্বে পুলিশ পরিদর্শক অপারেশন বিকাশ চন্দ্র সরকার সঙ্গীয় অফিসার ফোর্স নিয়ে অভিযান চালিয়ে বিমান বন্দর থেকে জীমকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। আজ বৃহস্পতিবার জীমকে সংশ্লিষ্ঠ মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More