মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : মেহেরপুরের মুজিবনগরে শোকের ছায়া নানা বাড়ি শায়িত হলো মাহিয়া : শোকে স্তব্ধ গ্রামবাসী প্রকৌশলী স্বামীর পর মেয়েকে হারিয়ে পাগল প্রায় আফরোজা

মুজিবনগর/নাটুদা প্রতিনিধি: মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামে নজরুল ইসলামের বাড়ির সামনে বিশাল একটি পাকুড়গাছ। সেই গাছের নিচে জড়ো হয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। সবার চোখে জল। সেখানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত লাশবাহী গাড়িতে আছে মাহিয়া তাসনিম ওরফে মায়ার মরদেহ। রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে দগ্ধ হয় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিয়া তাসনিম। গত পরশু বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। গতকাল শুক্রবার সকালে তার মরদেহ আনা হয় নানা নজরুল ইসলামের বাড়িতে। মাহিয়ার বাবার বাড়ি চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার উপজেলার কুড়ুলগাছি গ্রামে হলেও তার নানা বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার জয়পুরে তাকে দাফন করা হয়েছে। মাহিয়ার বাবা ইঞ্জিনিয়ার মহাম্মদ আলী প্রবাসে থাকাকালে পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। মা আফরোজা খাতুন বিউটি সেই থেকে বাবার বাড়ি জয়পুরে অবস্থান করেন। বাবা মারা যাবার পর পরিবারের সঙ্গে উত্তরার একটি ফ্লাটে বসবাস করতো মাহিয়া। সে মাইলস্টোন কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলো। গতকাল শুক্রবার ভোরে মাহিয়ার মরদেহ জয়পুরে পৌঁছালে সকাল ৮টায় দাফন সম্পন্ন হয়।
জানা গেছে, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে আফরোজা আক্তার বিথির সাথে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার উপজেলার কুড়লগাছি গ্রামে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। ২০১৯ সালে সপরিবারে দুবাইয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস। স্বপ্ন ছিলো বড় মেয়েকে নিজের মতো বুয়েট প্রকৌশলী বানাবেন। স্বামীর মৃত্যুতে দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আফরোজা। স্বামীর অপূর্ণ আশা পূরণ করতেই বড় মেয়ে মাহিয়া তাসনিমকে মাইলস্টোনে ভর্তি করান। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবি তাসনিম এগিয়ে যাচ্ছিলো লক্ষ্যের দিকে। দুই মেয়েকে আঁকড়ে ধরে স্বামীর শোক ভুলতে চেয়েছিলেন আফরোজা। কিন্তু নিয়তি বড়ই নির্মম। মেধাবি তাসনিম সেদিন কোচিং করতে শ্রেণিকক্ষে ছিলো। বিমান দুর্ঘটনায় তার শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যায়। বেশ কয়েকদিন লাইভ সাপোর্টে থাকার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার পর থেকেই মেয়েকে হারানোর অশনি সংকেতে পাগল প্রায় মা আফরোজা। শেষ পর্যন্ত সবাইকে কাঁদিয়ে মাহিয়া চলে গেলো না ফেরার দেশে। আত্মীয়-স্বজনরাও এই শোকে বাকরুদ্ধ। অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় তাই কেউ নেবে না দায়। ক্ষোভ প্রকাশ করলেন স্বজনদের কেউ কেউ।
এদিকে শুক্রবার ভোরে মাহিয়ার মরদেহ মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামে পৌঁছালে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পরিবারের লোকজন, স্বজন ও গ্রামবাসীরা। পরিবার-পরিজন ও গ্রামবাসীর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহতের মা, মামা, নানা ও প্রতিবেশীরা। মাহিয়ার মামা তারিকুল ইসলাম বলেন, বিমান দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যাই। তার আগে উদ্ধারকর্মীরা মাহিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যান। মাহিয়ার কোচিং ছিলো, বিমান দুর্ঘটনার সময় দৌড় দিয়ে চলে আসার সময় দগ্ধ হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেলে মাহিয়া মারা যায়।
মাহিয়া তাসনিমের ফুফাতো ভাই মাহাদি তাসিম রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, তাসনিমের বাবা মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কুড়ুলগাছি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি প্রকৌশলী ছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি মারা যান। ঢাকার উত্তরায় নিজেদের বাসায় থাকতেন তাসনিমের মা আফরোজা খাতুন ও দুই মেয়ে। তাসনিম ছিলো বড়। ছোট মেয়ে মালিহা তাবাচ্ছুম নুসরাতের বয়স ছয় বছর। তাসনিম পড়াশোনা করছিলো মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণিতে।
তাসনিমের ফুফু রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ভাই মারা যাওয়ার পরে ভাবি আফরোজা খাতুন দুই মেয়েকে নিয়ে উত্তরায় এলাকায় থাকতেন। যুদ্ধবিমানটি বিদ্যালয়ে বিধ্বস্ত হলে তাসনিম আমাকে প্রথমে ফোন করে জানায়। পরে আমি ও ভাবি বিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারি, তাসনিমকে নেয়া হয়েছে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সে মারা যায়। তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিলো।’
নিহত মাহিয়া তাসনিম মায়ার চাচা আসকার আলী জানান, আমাদের মেয়ে মারা যাওয়ায় আমরা বাকরুদ্ধ কথা বলার মতো ভাষা নেই, আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন। আমাদের মেয়ে একাই মারা যায়নি একটা বিমানের কারণে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে, যা মেনে নেয়া যায় না। এধরনের দুর্ঘটনা যাতে আর না হয়। আর কোন মায়ের সন্তান যেন না হারিয়ে যায়।
মাহিয়ার মা আফরোজা খাতুন বিউটি বিমানবাহিনীর ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, প্রশিক্ষণ বিমান কেন আবাসিক এলাকার ওপর দিয়ে উড়ালো? দুর্ঘটনায় আমার মেয়ে মারা গেল। তারা কি আমার মেয়ে ফেরত দেবে? বিমান জঙ্গল বা সমুদ্রের ওপর দিয়ে চালাতে পারতো। আফসোস আমার মেয়ের আশা আমি পূরণ করতে পারলাম না।
নাতনির মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গেছেন নানা নজরুল ইসলাম। কথা বলার সময় বারবার কেঁপে উঠছিল তার কণ্ঠ। তিনি বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটি আমেরিকায় থাকে। বড় মেয়েটি তাসনিমের আম্মু আফরোজা খাতুন। তাসনিম কয়দিন পোড়া শরীর নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছে। কিন্তু শরীরের বেশির ভাগ পুড়ে যাওয়ায় বাঁচতে পারেনি। আমার মেয়েটি স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে জীবন চালিয়ে যাচ্ছিল। এখন আরেক শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এই শোক থেকে কীভাবে উঠবে?’ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জানাজা শেষে জয়পুর গ্রামের কবরস্থানে তাসনিমকে দাফন করা হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের জন্য শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বে শোক পালন করা হচ্ছে। দেশের মানুষও শোকে স্তব্ধ। এই অকাল মৃত্যুর ঘটনায় মাহিয়া তাসনিম মায়ার নানা বাড়ি জয়পুর গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তার এমন মর্মান্তিক মৃত্যু এলাকাবাসীর হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More