কার্পাসডাঙ্গার ফকিরাখাল ; ২০০০ সালের স্মরণীয় বন্যায় লাখো মানুষের জীবনরক্ষার গল্প : অতি বর্ষণে এখনো জানান দেয় সেই ভয়াবহতা

রবিউল ইসলাম বাবু: স্মৃতি যখন বিষাদ ছুঁয়ে যায়, তখন ইতিহাস হয়ে ওঠে হৃদয়ের ধ্বনিত বেদনা। ২০০০ সালের সেই বর্ষা মরসুমে এমনই এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে গিয়েছিল দামুড়হুদা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামবাসীর মানুষের হৃদয়কে। সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কার্পাসডাঙ্গা মৌজায় অবস্থিত ফকিরাখাল হয়ে উঠেছিল লাখো মানুষের বাঁচার শেষ আশ্রয়। সে সময় বয়সটি আমার ছিল মাত্র ১২ বছর। সময়টা ছিল বর্ষাকালের মাঝামাঝি। হঠাৎই ভারতের ভেতর থেকে প্রবল গতির পানির স্রোত নেমে আসে। মুন্সিপুর ও ঠাকুরপুর সীমান্ত দিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সকালে ঘুম ভাঙতেই ঠাকুরপুর থেকে কান্না জড়ানো গলায় আমার নানা সম্পর্কের মজিবর রহমান এসে জানালেন সব শেষ। গরু, ছাগল, খাদ্য, বস্ত্র কিছুই বাঁচাতে পারিনি। তোমরা গুছিয়ে নাও, পানি ঢুকে গেছে। কেউ বুঝে উঠতে না উঠতেই এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টার ব্যবধানে মাঠঘাট প্লাবিত হয়ে পড়ে। দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ও নাটুদা অঞ্চলের মানুষের চোখের সামনে এক বিভীষিকাময় চিত্র ধরা দেয় যেদিকে তাকানো যায়, শুধু পানি আর পানি। ভেসে আসে গবাদিপশু, কখনও মানুষের মরদেহ। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় গোটা জনপদ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝেই আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফকিরাখাল। দুই গ্রাম কার্পাসডাঙ্গা ও কানাইডাঙ্গার মাঝখানে অবস্থিত এই খালটি দিয়ে পানি গিয়ে মিশে যেত ভৈরব নদীতে। কিন্তু সেই সময়ে খালের চওড়া ছিল অপর্যাপ্ত। তখন নিরুপায় হয়ে কার্পাসডাঙ্গা ও নাটুদা অঞ্চলের হাজারো মানুষ একত্রিত হয়ে ফকিরাখাল ও তার পাশ থেকে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ ফিট রাস্তা ভেঙে দেয়া হয় একটি সিদ্ধান্তে। ফলে রক্ষা হয়েছিল শত শত প্রাণ। বাঁচার লড়াইয়ে মানুষের ঐক্যই বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছিল সেদিন। সেই সময় মানুষ বাঁচার জন্য নিজের হাতেই সাপল, কোদাল দ্বারা রাস্তা ভাঙ্গা হয়েছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আবাল বৃদ্ধরাও দাঁড়িয়েছিল সেই লড়াইয়ে। ফলে পাকারাস্তা ভেঙে পানি বের হওয়াতে কিছুটা হলেও রক্ষা পায় কার্পাসডাঙ্গা,নাটুদা ইউনিয়ন সহ আশপাশের জনপদ। এক মাসের বেশি সময় পানিবন্দি ছিল এই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। ভরপুর পানি ছিল, ভাত ছিল না বন্যায় মাঠের সমস্ত চাষাবাদ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নদী, বিল আর বাড়ির উঠানে প্রচুর মাছ থাকলেও, বহু পরিবারে ভাত রান্নার মতো চাল ছিল না। শাকসবজি থাকলেও খাওয়ার উপকরণ ছিল না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কিছু সংস্থা। বিভিন্ন সামাজিক ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তবুও দুর্ভোগের সীমা ছিল না। ভেসে গিয়েছিল বহু ঘরবাড়ি। স্কুল, মসজিদ, খেলার মাঠ সবই ছিল পানির নিচে। আজও স্মৃতিতে বয়ে যায় সেই কান্না। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, জীবনে অনেক বৃষ্টি দেখেছি, কিন্তু এমন বন্যা দেখিনি। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারতাম না আতঙ্কে। জাহানারা নামের একজন নারী জানান, তরকারি ছিল, মাছও ছিল, কিন্তু ভাত রান্না করব কী দিয়ে তা নিয়ে আতঙ্ক ছিল প্রতিদিন। সবার ঘরবাড়ি তো পানিতে ভেঙ্গে গিয়েছিল। পরে সবাই রাস্তার উপরে গিয়ে তাঁবু গেড়ে ছিলাম প্রায় মাস খানেক। যুবকেরা বলেন, এলাকায় বন্যা হয়েছিল শুনি কিন্তু আমাদের বিশ্বাসই হয় না। তবে ঘটে যাওয়া সেই সময়টা কারো মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়। গতকাল শনিবার কানাইডাঙ্গা গ্রামের বন্যা কবলিত রফিকুল ইসলাম আবেগপ্রবণতার সাথে বলেন, অতি বৃষ্টি হলেই ভয়াবহ সেই বন্যার কথা মনে পড়ে যায়। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের বিভীষিকাময় করুন দৃশ্য। সেই বন্যা অনেকের কাছেই যেন এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। তবে মানুষ যখন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তখন কোনো দুর্যোগই তাদের হারাতে পারে না এই বার্তাও দিয়েছে সেই দুর্যোগ। আর সেই বার্তারই প্রতীক হয়ে আজও ইতিহাস হয়ে আছে ফকিরাখাল।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More