‘আরে ও কীসের নেতা হবে!’ — কথাগুলো ডিয়েগো ম্যারাডোনার, বলেছিলেন লিওনেল মেসিকে নিয়ে। তিনি পরে আরও বলেছিলেন, ‘ও তো শুধু বার্সেলোনারই। ওই জার্সিটা পরলে সে মেসি। তবে সে যখন আর্জেন্টিনার জার্সিটা গায়ে চড়ায়, তখন সে পুরোপুরি অন্য মানুষ।’
তিনি মেসির কাছের মানুষ ছিলেন, কোচিংও করিয়েছেন তাকে। সেই ব্যক্তিটি যখন এই কথা বলবেন, তখন পুরো আর্জেন্টিনার কথাটা ভাবুন? ভাবতে হবে না। একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক, চলুন।
তখন আর্জেন্টিনায় এলে স্রেফ মরুভূমিই দেখছেন মেসি। একে একে তিনটা ফাইনালে তুললেন দলকে, কিন্তু শিরোপা জেতাতে পারলেন না। তখন আর্জেন্টিনায় তাকে নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে। সমর্থকরা তার পোস্টারও পুড়িয়েছেন, এমনও ছবি ভেসে বেড়িয়েছে সংবাদ মাধ্যমে।
আর্জেন্টিনায় মেসির গেল দশকটা এমনই কেটেছে। দারুণ মৌসুম কাটিয়ে যখনই আর্জেন্টিনায় পা রেখেছেন, সেখানে সবকিছু ভোজবাজির মতো বদলে গেছে, হতাশা তার পথ আগলে ধরেছে সবসময়।
তবে দৃশ্যটা বদলে গেল চলতি দশকের শুরুতে। ২০২১ কোপা আমেরিকা শিরোপাটা যখন জিতলেন, ২৮ বছরের খরাটা যখন কাটালেন। ডিয়েগো ম্যারাডোনা বিষয়টা দেখে যেতে পারেননি, তবে গোটা আর্জেন্টিনা দেখল। আর তাতেই যেন সব বিতৃষ্ণা, নিরতিশয় অপছন্দ বদলে গেল স্তুতি আর ভালোবাসায়।
বিশ্বকাপটাকে একটা সময় মনে হচ্ছিল দূর আকাশের তারা, যার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখাই যায়, ছুঁয়ে যাকে দেখা যায় না। সেটাও যখন ঘরে তুললেন ম্যারাডোনার মতো কীর্তি গড়ে তখন থেকে সে ভালোবাসাটা ক্রমে বেড়েছেই। মেসি সে বাড়তি ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছেন আরও একটা কোপা আমেরিকা জিতিয়ে।
আর্জেন্টিনাকে এতটা আনন্দে ভাসানো মেসি এবার আর্জেন্টিনার মাটিতে শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচটা খেলে ফেলেছেন। আর তা যখন খেলতে নামছেন, তখন গোটা আর্জেন্টিনা ভেসে গেল আবেগে।
শুধু আর্জেন্টিনা বললে বোধ হয় ভুল হবে। গোটা বিশ্বই তো আবেগে ভেসে গেল! ম্যাচটা ছিল স্রেফ আর্জেন্টিনায় তার শেষ অফিসিয়াল ম্যাচ, এরপর যে আরও কিছু দিন খেলবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবু বৈশ্বিক সংবাদ মাধ্যমে তা প্রচার পেল তার বিদায়ী ম্যাচের মতোই। শুধু কি সংবাদ মাধ্যম? আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুললেও তো একই দৃশ্য দেখে থাকবেন! এতসব কিছু শুধু তিনি মেসি বলেই তো!
আচ্ছা সেসব বাদ, মেসি তার দেশে কেমন ভালোবাসা পেয়েছেন দেখা যাক। সংবাদ সম্মেলনে মেসির শেষের শুরু নিয়ে কথা বলছিলেন কোচ লিওনেল স্কালোনি, জানাচ্ছিলেন পরবর্তী মেসি কে হবেন সেটাও। আর তখন আবেগ ধরে রাখতে না পেরে এক সাংবাদিক কি-না কেঁদেই ফেললেন! আর সে আবেগ তখন ছুঁয়ে গেল কোচ স্কালোনিকেও।
এরপর আজ ম্যাচে সে আবেগ চূড়া ছুঁয়ে গেল রীতিমতো। তিনি যখন মাঠে নামছেন, বিপুল করতালিতে তাকে বরণ করে নেন এস্তাদিও মনিউমেন্তালে হাজির ৮০ হাজার দর্শক। মেসি তখন নিজেকে ধরে রাখলেন বেশ কষ্টে, এটাই যে শেষ, আর কখনো নিজের দেশে নিজের দর্শকদের সামনে এভাবে ম্যাচ খেলা হবে না!
ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যান বছর দশেক আগে। সেই একই দেশে মেসির কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে, কিংবদন্তিরা শূলে চড়িয়েছেন তাকে। এতটাই যে তার পাঁচ বছরের বাচ্চাটাও বুঝতে পেরেছে, তার বাবা এখানে মোটেও ভালোবাসার কেউ নয়। জানতে চেয়েছে, ‘বাবা, ওখানে মানুষজন কেন তোমাকে মেরে ফেলতে চায়?’ মেসি এক বুক কষ্ট নিয়ে সেসব প্রশ্ন সামলেছেন। মনে মনে হয়তো ভেবেছেন, ‘আগুনের দিন শেষ হবে এক দিন, ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন!’
আগুনের দিন শেষে গেল কটা বছর ছিল ঝর্ণার সাথে গানের দিন। সর্বজয়ের তৃপ্তি নিয়ে মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর দিন। সেসব উপভোগের লোভেই তো রয়ে গেলেন, নাহয় ২০২২ বিশ্বকাপের ওই ফাইনাল শেষেই তো বিদায় বলতে পারতেন!
দেখতে দেখতে সেই ঝর্ণার সাথে গানের দিনও ফুরিয়ে এল। এবার তার বিদায়ের পালা। তারই প্রথম পাঠ নিলেন আজ, দেশের মাটিকে বিদায় বলে। এখন যা খেলবেন, বিদেশের মাটিতে। ভালোবাসা পাবেন অবশ্যই, তবে দেশের মানুষের মতো ভালো কে বাসতে পারে বলুন?
সেটা মেসিও জানতেন। আর তাই তো অমরত্বের প্রত্যাশাকে পায়ে ঠেলে হলেও এই ভালোবাসাটাকেই চেয়েছেন খুব করে! তার মুখ থেকেই শুনুন, ‘অনেক বছর বার্সেলোনায় ভালোবাসা পেয়েছি। আমার স্বপ্ন ছিল দেশে, নিজের মানুষের কাছ থেকেও তা পাওয়া।’
শেষ কয়েক বছরে সে ভালোবাসাটা বুক ভরে নিয়েছেন তিনি। বার্সেলোনার রাস্তায় একটা সময় তাকে নিয়ে যে উন্মাদনা হতো, তা অবশেষে দেখা গেল আর্জেন্টিনাতেও। এমনভাবেই বিদায়টা নিতে চেয়েছিলেন।
সেটা হলো অবশেষে, আর তাতেই তৃপ্ত মেসি। তিনি বললেন, ‘আর্জেন্টিনায় আমাদের মানুষদের সামনে খেলাটা সবসময়ই আনন্দের। আমরা অনেক বছর ধরে একসঙ্গে উপভোগ করছি। আমি খুব খুশি, কারণ আমি যেমনটা সবসময় স্বপ্ন দেখতাম, ঠিক তেমনভাবেই এখানে শেষ করতে পেরেছি।’
বিদায়বেলায় আবেগে ভাসলেন মেসি। সেটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে এবেলায় তার চোখের সে অশ্রু সুখানুভূতির, তৃপ্তির।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.