আ.লীগ আমলে লুটের জন্য দখল করা হয় যেসব ব্যাংক

ব্যাংক খাতে জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা বড় অঙ্কের সব ঋণই এখন খেলাপি হচ্ছে। এ কারণে অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। যা ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেসব ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি বেশি হয়েছে, সেগুলোতেই বর্তমানে খেলাপি ঋণের বোঝা বেশি। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে জালিয়াতির শিকার ব্যাংকগুলোই বর্তমানে বেশি দুর্বল। এর মধ্যে অতি দুর্বল ৫টি ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে। ব্যাংক খাতের হালনাগাদ সার্বিক চিত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। লুটপাট করতে ১১টি ব্যাংক দখল করা হয়েছে। ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকে রাখা আমানতকারীদের টাকা যেমন আত্মসাৎ করা হয়েছে, তেমনি ওইসব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচার করা টাকায় বিদেশে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিলাসবহুল প্রতিষ্ঠান। পাচারের টাকায় জালিয়াতরা এখন দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

এর মধ্যে গত সরকারের মন্ত্রী, সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, আমলা ও ব্যাংকাররা আছেন। তারা ব্যাংক খাত থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। যেগুলো এখন পর্যায়ক্রমে খেলাপি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার জন্য দায়ী মূলত গত সরকারের আমলে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি অর্থাৎ যেসব ঋণ প্রচলিত নিয়মকানুন ভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। সমাজের মধ্যে গড়ে ওঠা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি এবং সমাজের বহুপাক্ষিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই ব্যাংক খাতে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বাড়ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ধরনের ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সংস্কার ও বিধিবিধানের কঠোর প্রয়োগ শুরু করেছে। বিশেষ করে বড় অঙ্কের ঋণগুলোতে কঠোর তদারকি আরোপ করেছে। যেগুলো খেলাপি হচ্ছে সেগুলো আদায় বা ঋণের অর্থ কোথায় গেছে তার অনুসন্ধান করছে। শিল্পে বিনিয়োগ হয়ে থাকলে শিল্প সচল করার চাপ দিচ্ছে। ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের মানে যাতে ঝুঁকি না বাড়ে এবং আমানতকারীদের ওপর যাতে আঘাত না আসে সেদিকে সতর্ক আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিগত সরকারের আমলে জালিয়াতির মধ্যে হলমার্ক গ্রুপের নেওয়া ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণের সবই খেলাপি। বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে এন্যান টেক্স গ্রুপের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই এখন খেলাপি। ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে অর্ধেকের বেশি খেলাপি। ব্যবসা সচল রাখার জন্য কিছু ঋণে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা জালিয়াতির পুরোটাই খেলাপি। গ্রুপের মালিক পক্ষ ওইসব টাকা বিদেশে পাচার করে দুবাইয়ে ব্যবসা ও বিলাসী জীবন যাপন করছেন।

এস আলম গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছেন। এর মধ্যে পাচার করেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। গ্রুপের এখন খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের ঋণ ১৩ হাজার কোটি টাকা, খেলাপি ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

অপর একটি গ্রুপের মোট ঋণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা এর মধ্যে খেলাপি ৭ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। নাসা গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ৯ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। রপ্তানি বিলের অর্থ দেশে এনে গ্রুপের কিছু ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে। ওরিয়ন গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি দেড় হাজার কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ৯ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। খেলাপি ৭ হাজার কোটি টাকা। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মোট ঋণ ১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। বেনামে নিয়েছেন আরও ২ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ৬৪০ কোটি টাকা। এছাড়া চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ নিয়েছে সেগুলো এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংক দখল করে লুটপাট শুরু হয়। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে লুটপাট চরমে ওঠে। এ কারণে ওই সময়ে খেলাপি ঋণও মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৬ হাজার ১২০ কোটি টাকা। ওই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর আগে দীর্ঘ সময় ব্যাংকগুলোতে গড়ে কোনো প্রভিশন ঘাটতি ছিল না। বরং প্রভিশন উদ্বৃত্ত ছিল। এর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ৮৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকায় নামে। ওই সময়ে প্রভিশন ঘাটতিও কমে দাঁড়ায় ১২০ কোটি টাকায়।

এরপর থেকে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। ২০২১ সালের জুনে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ২১০ কোটি টাকা। একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতিও বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিতীয়বারের মতো লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। ওই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকায়। এ সময়ে প্রভিশন ঘাটতিও বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে সময়ে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছিল। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়। প্রভিশন ঘাটতিও বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকায়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ওই মাসের জুনের খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে নতুন সরকার। তারা জানায় আওয়ামী লীগ আমলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হতো না। তথ্য গোপন করে খেলাপি ঋণ কম দেখাত। যে কারণে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধির ছিল কম। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে জালিয়াতির সব ঋণ খেলাপি দেখাতে শুরু করে। এতে বেপরোয়া গতিতে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ। ২০২৪ সালের জুনে তা বেড়ে ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায়।

২০২৪ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ৩৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে বেড়েছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা এবং বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। ওই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি প্রথমবারের মতো লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়। ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা, বৃদ্ধির হার ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ওই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More