দাবি নিষ্পত্তিতে বিমা কোম্পানির গড়িমসি, অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টাকে বিটিএমএর চিঠি

গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন স্থানে টেক্সটাইল মিল দুষ্কৃতকারীদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিমা কোম্পানিগুলো এসব কারখানার দাবি নিষ্পত্তিতে গড়িমসি করছে। পদ্ধতিগত জটিলতা ও পলিসির শর্তের অপব্যাখ্যা দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছে কোম্পানিগুলো। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত বিমাদাবি নিষ্পত্তিতে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সোমবার অর্থ উপদেষ্টা ও বাণিজ্য উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে দেশব্যাপী সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে অনেক টেক্সটাইল মিলের কারখানা, গুদাম এবং অন্যান্য স্থাপনা ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। আকস্মিক এই সহিংসতার ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে এবং উদ্যোক্তারা বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এই অপ্রত্যাশিত ক্ষতি মোকাবিলার জন্য প্রায় প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানই যথাযথ প্রিমিয়াম পরিশোধের মাধ্যমে বিমা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অগ্নি এবং সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির বিপরীতে বিমা পলিসি গ্রহণ করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত ঘটনার পর বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ বিমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

এতে আরও বলা হয়, বিমা কোম্পানিগুলো নানা ধরনের পদ্ধতিগত জটিলতা এবং পলিসির শর্তের অপব্যাখ্যা করে দাবি পরিশোধে বিলম্ব করছে। অনেক ক্ষেত্রে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা-সংক্রান্ত ক্ষতির অজুহাতে দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা বিমা শিল্পের মূলনীতির পরিপন্থি। বিমা শিল্পের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা বা হস্তক্ষেপ না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প মালিকরা চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এই অচলাবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাগুলো পুনরায় উৎপাদন শুরু করতে সমস্যার সম্মুখীন। ফলে হাজারো শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এটি কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সংকট নয় বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি খাতের সাপ্লাই চেইনের ওপর মারাত্মক আঘাত।

গত ৩ মার্চ সাধারণ বিমা করপোরেশনে পুনঃবিমা মহাব্যবস্থাপকের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, জুলাই-আগস্টের সব ঘটনা পপুলার রাইজিং বা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হলেও অগ্নি ও শিল্প ঝুঁকির পলিসির আওতায় কাভারেজ থাকা সত্ত্বেও কোনো বিমাদাবি পরিশোধযোগ্য হবে না। এ সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে নেওয়া হয়েছে এবং এটি দেশের শিল্প ও অর্থনীতির স্বার্থবিরোধী। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আয়োজিত সভায় সংশ্লিষ্ট অংশীজন বিশেষত বিমা ও বাণিজ্য সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

বিটিএমএর চিঠিতে বলা হয়েছে, বিমা চুক্তির দুটি প্রধান পক্ষ হলো বিমাকারী ও গ্রহীতা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকার দাবি নিষ্পত্তির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বিমাগ্রহীতাদের কোনো প্রতিনিধিকেই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটি স্বাভাবিক ন্যায়নীতি এবং আইনের মৌলিক নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটি একটি গুরুতর পদ্ধতিগত ক্রটি, যা পুরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

গত বছরের ১৬ জুলাই-পরবর্তী সব সহিংসতার ঘটনাকে ‘পুপলার রাইজিং’ আখ্যা দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিটিএমএ বলছে, বাস্তবতা হলো এই সময়ের মধ্যে সংঘটিত প্রতিটি সহিংস ঘটনা এক প্রকৃতির ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্যমান অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতা, ডাকাতি, লুটতরাজ বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলো দাঙ্গা, নাগরিক বিশৃঙ্খলা বা বিদ্বেষমূলক ক্ষতির সংজ্ঞার আওতায় পড়ে, যা বিমা কভারেজের মূলভিত্তি। তাই প্রতিটি দাবি বিমা আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার বিধান আছে।

অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, বিমার মূল উদ্দেশ্যই হলো বিপদের দিনে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করে অর্থনীতিকে সচল রাখা। যদি দেশের ক্রান্তিকালে আইন ও পলিসির কঠোর, সংকীর্ণ এবং ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সব দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়, তবে তা কেবল ক্ষতিপ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেউলিয়া করবে না, বরং পুরো বিমা শিল্পের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট করবে। এর ফলে বিমা গ্রহণে অনীহা তৈরি হবে, যা এই শিল্পের জন্য আত্মঘাতী হবে।

বিটিএমএর ৪ প্রস্তাব : সংকট নিরসনে বিটিএমএ থেকে ৪টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-আইডিআরএ থেকে সব নন-লাইফ বিমা কোম্পানিকে সুস্পষ্ট সার্কুলার জারির মাধ্যমে ৯০ দিনের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তির বিধান কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার নির্দেশনা দেওয়া। ‘দাঙ্গা ও হাঙ্গামা’-সংক্রান্ত ধারার যৌক্তিক এবং স্বচ্ছ ব্যাখ্যা প্রদান করা, যাতে বিমা কোম্পানিগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এর অপব্যবহার করতে না পারে। পুনঃবিমার অংশ দ্রুত ছাড় করতে সাধারণ বিমা করপোরেশনের সঙ্গে আইডিআরএকে সমন্বয় করা। পাশাপাশি গত ৩ মার্চের সভায় নেওয়া একতরফা, ত্রুটিপূর্ণ এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল করার ব্যবস্থা নেওয়া।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More