চোখের আলো নিভেছে, মনের আলোয় চলছে তাঁর জীবনসংগ্রাম: চুয়াডাঙ্গার জহুরুল ইসলাম

শেখ রাকিব:চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার আইলস ইউনিয়নের বুড়োপাড়া গ্রামের জহুরুল ইসলাম মঙ্গল (৫৯) এক হার না মানা জীবনযুদ্ধের প্রতীক। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জহুরুল ইসলাম, পিতা মৃত নিজাম উদ্দিন জোয়ার্দ্দার ও মাতা জোহরা খাতুনের সন্তান। চরম দারিদ্র্য, কষ্ট আর সংগ্রামকে নিত্যসঙ্গী করে তাঁর পথচলা শুরু হয় শৈশব থেকেই।
 শৈশবের দুঃসহ স্মৃতি: মাত্র আড়াই বছর বয়সে রক্তের গ্রুপজনিত কারণে (বাবা-মায়ের রক্তের গ্রুপ এক হওয়ায়) একের পর এক তিন ভাই মারা যাওয়ার সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে বড় হন তিনি ও তাঁর ছোট বোন।সাত বছর বয়সে কর্মজীবনের শুরু
অর্থনৈতিক কষ্টের কারণে মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। চুয়াডাঙ্গা পোস্ট অফিসের সামনে ফিরোজের কাছে সাইকেল মেরামতের কাজ শেখেন তিনি। এরপর গড়াইটুপি খাড়াগোদা বাজারে আবুলের কাছে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে শেখেন ইঞ্জিনসহ নানান ধরনের মেশিনের কাজ। দৃষ্টি হারিয়েও থামেনি পথচলা
যন্ত্রপাতির সঙ্গে কাজ করতে করতেই একসময় তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। ঝাপসা হতে হতে অবশেষে তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে পড়েন। ২০১৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর সংসারের পুরো ভার এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। চোখে আলো না থাকলেও, জীবনযুদ্ধে একবিন্দুও হার মানেননি জহুরুল ইসলাম।
একসময় তাঁর দোকানে চার-পাঁচজন মিস্ত্রি কাজ করতেন। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রিক মেশিনের কারণে এখন কাজ অনেক কমে গেছে। বর্তমানে মাসে কোনো রকমে ছয়-সাত হাজার টাকা আয় হয়। দুই ছেলের উপার্জনের ওপরই ভরসা তাঁর এই ছোট্ট পরিবার।  দৃষ্টিশক্তি না থাকা সত্ত্বেও তিনি সাইকেল, মোটরসাইকেল, পাওয়ার টিলার, টিউবওয়েল বসানো এবং ইলেকট্রিক কাজ—সবই করে চলেছেন তাঁর ‘মনের চোখ’ দিয়ে। স্থানীয়দের চোখে জহুরুল ইসলাম
স্থানীয় বাসিন্দারা জহুরুল ইসলামের এই সংগ্রাম ও কর্মদক্ষতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।হেলাল হোসেন (স্থানীয়): “আমরা জহুরুল ভাইয়ের কাজ দেখি আর অবাক হই। অন্ধ মানুষ হয়েও এমন নিখুঁতভাবে সাইকেল, মোটরসাইকেল সারান—এটা অবিশ্বাস্য। তাঁর মনোবল দেখলে আমাদেরও সাহস বাড়ে।” আব্দুর রহিম (প্রতিবেশী): “তিনি কারও কাছে হাত পাতেন না। দৃষ্টি না থেকেও নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের কাছে তার জন্য একটু সহযোগিতা আশা করি, যাতে তাঁর কষ্টের জীবনটা একটু সহজ হয়।” মনোয়ার হোসেন (গ্রাহক): “আমি তাঁর কাছেই কাজ করাই। চোখ না থেকেও তাঁর কাজের মান অনেক মিস্ত্রির চেয়ে ভালো। যন্ত্রপাতির শব্দ শুনেই তিনি সমস্যার জায়গাটা বুঝে যান।”সুজন আলী (স্থানীয়): “ছোটবেলা থেকেই তাঁকে কাজ করতে দেখছি। এত বড় একটা ধাক্কা সামলে উঠে তিনি যেভাবে কাজ ধরে রেখেছেন, তা সবার জন্য অনুপ্রেরণা।”রাজু আহমেদ (স্থানীয়): “অনেক সাংবাদিক, ইউটিউবার আসে, ভিডিও করে নিয়ে যায়। কিন্তু তাঁর জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমরা চাই সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা তাঁর পাশে দাঁড়ান।”
নিজের জীবনসংগ্রাম নিয়ে জহুরুল ইসলাম বলেন, “অনেকে আসে ভিডিও করে, নিউজ করে চলে যায়। ওদের লাভ হয়, কিন্তু আমাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবুও আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে চলি। সমাজের প্রভাবশালী মানুষরা যদি একটু সহযোগিতা করতেন, তাহলে হয়তো পরিবারটাকে আরও ভালোভাবে চালাতে পারতাম।”
জহুরুল ইসলামের মতো মানুষ, যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চান, তাঁদের পাশে সমাজ ও বিত্তবানদের দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। তাঁর মনের আলোয় পথচলার এই সংগ্রাম অন্যদের জন্যও এক বিশাল অনুপ্রেরণা।
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More