চুয়াডাঙ্গায় গাড়ল পালনে সফল খামারী জগন্নাথপুরের হেবুল

মিরাজুল ইসলাম মিরাজ: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাটুদা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিশাল জায়গাজুড়ে এর অবস্থান। ছুটির পর বিদ্যালয়ের মাঠে খেলতে আসে শিক্ষার্থীসহ এলাকার শিশু-কিশোর-তরুণ। মাঠের পাশেই আরেকটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে প্রায় বিকেলে চরতে দেখা যায় একপাল গাড়ল। প্রাণীগুলো ঘুরে বেড়ায়, ঘাস খায়। আবার সন্ধ্যার আগে রাখালের ইশারায় খামারে ফেরে। গাড়লগুলোর মালিক লিখন মণ্ডল, এলাকায় যিনি হেবুল নামে পরিচিত। প্রায় ২২ বছর ধরে তিনি বিশাল গাড়ল খামার গড়ে তুলেছেন। ১২টি দিয়ে শুরু করে এখন তাঁর খামারে গাড়ল পাঁচ শতাধিক।

ছিলেন চা দোকানি;
২০০৪ সালের কথা। দামুড়হুদার নাটুদাহ ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের হেবুলের বয়স তখন ৩০। অভাবের কারণে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরোতে পারেননি। সংসার চালাতে নাটুদা ইউনিয়নের ঐতিহাসিক আটকবর মোড়ে কাঠের টং দোকান দিয়ে চা বিক্রি শুরু করেন হেবুল। সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চলছিল। কিন্তু অভাব যায় না। এক পর্যায়ে তাঁর মাথায় আসে, এভাবে হবে না। সচ্ছলতা আনতে অন্য কিছু করতে হবে। সেই কিছু একটা করার ভাবনা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন হেবুল। জমাতে থাকলেন টাকা।

হেবুল বলেন, অল্প অল্প করে জমানো এবং ধারদেনা করে মোট দুই লাখ টাকা জোগাড় করি। ২০০৪ সালে বাড়ির পাশে ছোট পরিসরে গাড়ল রাখার ঘর বানাই। এরপর বাকি টাকা নিয়ে চলে যাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কৃষ্ণনগর এলাকায়। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সেখান থেকে দুই জাতের (হাইক্রস ও অরিজিনাল) ১২টি গাড়ল কিনে শুরু করি খামার। এখন খামারে দুই জাতের ৫৫০টি গাড়ল রয়েছে, যেগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার গাড়ল বিক্রি করি। তিন রাখালের বেতনসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে বছরে গড়ে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা। গাড়ল খামারের আয় থেকে জমি কিনেছি, বাড়ি করেছি, মোটরসাইকেল কিনেছি, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমার ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ইমান আলী বলেন, হেবুল একসময় অনেক কষ্টে জীবনযাপন করেছেন। এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা।

বাড়ছে উদ্যোক্তা;
কঠোর পরিশ্রম করে অভাবের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন এক সময়ের চা দোকানি হেবুল। তাঁর বয়স এখন ৫২। চুলে পাক ধরেছে। তাঁর কাছ থেকে গাড়লের বাচ্চা কিনে এবং তাঁর দেখাদেখি গাড়ল পালনে উদ্যোগী হয়েছেন উপজেলার প্রায় ২০ জন। তিনি তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। বর্তমানে বাড়ির পাশের সাড়ে চার বিঘা জমির ওপর হেবুলের গাড়লের খামার। গাড়ল ছাড়াও বিভিন্ন শেডে ১২০টি ছাগল, ১৫০টি হাঁস-মুরগিসহ কবুতর পালন করছেন তিনি।

হেবুল জানান, গাড়ল খুবই শান্ত স্বভাবের প্রাণী। এগুলোর নিয়মিত পরিচর্যা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালে কোনো ঝুঁকি থাকে না। তবে শীত মৌসুমে একটু ঝুঁকি আছে। এ সময় বাসস্থান নিরাপদ রাখতে হয়। তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। এ ছাড়া নিয়মিত কৃমির ডোজসহ বিভিন্ন টিকার মাধ্যমে গাড়লকে সুস্থ রাখা যায়।

বেশি গাড়ল দামুড়হুদায়;
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলায় ৪২ হাজার ৭২১টি গাড়ল পালন করা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পালন হচ্ছে দামুড়হুদা উপজেলায়; ২১ হাজার ৩৯৭টি। এ ছাড়া খামার ও ব্যক্তি পর্যায়ে সদর উপজেলায় ১১ হাজার ৫২৯টি, আলমডাঙ্গায় সাত হাজার ৮০০টি ও জীবননগর উপজেলায় এক হাজার ৯৮৫টি গাড়ল পালন করা হচ্ছে। এটি পালন লাভজনক হওয়ায় শিক্ষিত বেকার ও দরিদ্ররা এ পেশায় ঝুঁকছেন। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে নানা পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে খামারিদের।

চাহিদা রয়েছে এ প্রাণীর;
গাড়ল ও ভেড়া দেখতে প্রায় একই রকম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেবুল বলেন, গাড়ল মূলত ভেড়ার জাত। এর দেহ সুঠাম, আকারে বড়, কান ও লেজ লম্বা হয়। আর ভেড়ার কান, লেজ ছোট এবং ওজন কম। গাড়ল বছরে দুবার সর্বোচ্চ তিনটি বাচ্চা দেয়। প্রথমবার এক বছর বয়সে বাচ্চা দেয়। একটি পরিপূর্ণ গাড়লের ওজন হয় ৬০ থেকে ৮০ কেজি, যা ৫০-৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। দেড় ও দুই মাস বয়সী বাচ্চা ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। চার-পাঁচ মাস বয়সী বাচ্চার দাম ১০ হাজার টাকা।
কোথায় বিক্রি করেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, খামারি, উদ্যোক্তারা বাচ্চা গাড়ল কেনেন। আর বড় গাড়ল ও মাংস নেয় বিভাগীয় ও রাজধানীর রেস্তোরাঁগুলো। বর্তমানে আমার খামারে আনুমানিক ৪০ লাখ টাকার গাড়ল রয়েছে। প্রতিটি গাড়লের পেছনে দৈনিক ১৫-২০ টাকা খরচ হয়।

দামুড়হুদার আরেক গাড়ল খামারি চারুলিয়া গ্রামের নাসিরুল ইসলাম। তাঁর রয়েছে ২৩০টি গাড়ল। তিনি বলেন, একটু বুঝে পালন করলে অল্প সময়েই লাভবান হওয়া যায়। চুয়াডাঙ্গা জেলা গাড়ল পালনের জন্য উপযোগী। এ প্রাণীর খাবার নিয়ে তেমন সমস্যা হয় না। সবুজ ঘাস, খড়কুটো, ভুট্টা খাওয়ালে গাড়ল বেশি বাড়ে। গাড়লের মাংস সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদাও বেশি। ঈদের সময় ব্যাপক চাহিদা এর।

খাবার ও পরিচর্যা;
খামারের রাখাল আরমান বলেন, সকালে গাড়লের ঘর পরিষ্কার করে দানাদার ও সবুজ ঘাস খাওয়ানো হয়। দুপুরের পর পাল নিয়ে আশপাশের চারণভূমি, ধান কাটার পর ফাঁকা মাঠ এবং খামার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়ের মাঠে চরাতে যাই। সন্ধ্যা নামার আগেই আবার গাড়লের পাল নিয়ে ফিরতে হয়। খামারে ফিরে গাড়লগুলোকে পানি খাওয়ানোর পর বাসস্থানে রেখে আমাদের ওই দিনের মতো ছুটি। শীত মৌসুমে বাসস্থান ঢেকে রাখি। বাচ্চাগুলোকেও গরম কাপড় দিয়ে ঢেকে দিই।

হেবুলের বিষয়ে তিনি বলেন, হেবুল ভাই মাস শেষ হলেই আমাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দেন। গত ১০ বছর ধরে তাঁর খামারে কাজ করছি। বিপদ-আপদে তিনি আমাদের সহযোগিতা করেন।

খোঁজ রাখে প্রাণিসম্পদ বিভাগ;
প্রাণিসম্পদ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে হেবুলের। তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা নিয়মিত খামার পরিদর্শনসহ সার্বিক খোঁজ রাখেন।

দামুড়হুদা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নীলিমা আক্তার হ্যাপি বলেন, গাড়ল একটি সম্ভাবনাময় খাত। জেলায় গাড়ল পালনে সফল ও বড় উদ্যোক্তা হেবুল মণ্ডল। প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে নিয়মিত তাঁর খামারের গাড়লের পিপিআর ভ্যাক্সিন ও কৃমিনাশক দিয়ে সহযোগিতা করা হয়।

জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের উপপরিচালক আ হ ম শামীমুজ্জামান জানান, গাড়লের সাধারণত পিপিআর ও কৃমি-সংক্রান্ত রোগবালাই হয়। এ রোগ প্রতিরোধে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে নিয়মিত টিকা দিয়ে সহযোগিতাসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More