বগুড়ার প্রথম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এপিপি, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতৃস্থানীয় সদস্য অ্যাডভোকেট তানজিম আল মিসবাহর ভুয়া আগাম জামিন আদেশ তৈরির ঘটনা ফাঁস হয়ে গেছে। তার এ ভুয়া জামিন বাণিজ্যের খপ্পরে পড়ে ৮৫ হাজার টাকা ফি দিয়েও ৩০ পরিবহণ মালিক-শ্রমিক ৭০ দিন হাজত খেটেছেন। প্রতারণার শিকার বগুড়ার পরিবহণ মালিক আমিনুল ইসলাম সম্প্রতি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তার ওকালতির লাইসেন্স বাতিলের জন্যও আবেদন করা হয়েছে।
এর আগে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা করা হয়। সিআইডির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের যৌথ বেঞ্চ গত ৯ জুন বুধবার অ্যাডভোকেট তানজিমসহ দুই আইনজীবী ও এক কম্পিউটার অপারেটরকে দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এ মামলায় গ্রেফতার এক মহুরি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরিবহণ মালিক আমিনুল ইসলাম জালিয়াতি চক্রের চার সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
এজাহার সূত্র জানায়, বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের কর্তৃত্ব দখলে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের নেতৃত্বে তার লোকজন গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে শহরের চারমাথা এলাকায় গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম ও তার লোকজনের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এতে পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। আমিনুল ইসলামের ব্যক্তিগত, কাউন্সিলর কার্যালয় ও গ্রুপের কার্যালয়ে আগুন দিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। এ সময় কয়েকটি যানবাহনও ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনায় মোহনের পক্ষে তার ছোটভাই মশিউল আলম পরদিন সদর থানায় শহর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিনুল ইসলামসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অপরদিকে আমিনুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত অফিসে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মোহনকে প্রধান আসামি করে ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত দেড় শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন।
বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগ নেতা ও পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম গত ২৪ মে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বগুড়া শহরের শিববাটী এলাকার অ্যাডভোকেট এনএম কাইছারুজ্জামানের ছেলে প্রথম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এপিপি ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য অ্যাডভোকেট তানজিম আল মিসবাহের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, অ্যাডভোকেট তানজিম আল মিসবাহ তাকে (আমিনুল) ও ২৯ জন শ্রমিককে হাইকোর্ট থেকে জামিন করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ১২ ফেব্রুয়ারি বিকালে ৩০ জনের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেন। এছাড়া হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনের জন্য ৮৫ হাজার টাকা ফি নেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভোকেট তানজিম জানান, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ভার্চুয়ালি ৩০ আসামিকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন। এ মর্মে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেন। এছাড়া ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে ফৌজদারি মিস কেসের (নং-৪০৫৪২/২১, ১৫ ফেব্রুয়ারি) সত্যায়িত অবিকল প্রতিলিপির সার্টিফায়েড কপি দেন। ওই আদেশনামায় দেখানো হয়, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ আসামিদের ছয় সপ্তাহের জামিন দিয়েছেন। জামিন শেষে তাদের নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব ভুয়া কাগজপত্র বগুড়া সদর থানায় জমা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জানতে পারেন হাইকোর্টের ওই আদেশটি জাল। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে সুয়োমটো রুল ও অর্ডার জারি করা হয়। এরপর পুলিশ প্রতারণার অভিযোগে আমিনুল ইসলাম ও ২৯ শ্রমিককে গ্রেফতার করে। তারা ৭০ দিন হাজত খাটতে বাধ্য হন।
গ্রেফতারের আগে আমিনুল ইসলাম প্রতারণার ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর তিনি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পিটিশন মামলা (নং-১৬৪/২১) করেন। আদালত এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করতে রমনা থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। ৩ এপ্রিল রমনা থানায় মামলা (নং-০৪) রেকর্ড করা হয়। ভুয়া আগাম জামিন আদেশ তৈরির ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করে জালিয়াতি চক্রের চার সদস্যের সন্ধান পান। এরা হলেন-ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী রাজু আহমেদ রাজিব, বগুড়া আদালতের আইনজীবী তানজিম আল মিসবাহ, ঢাকা জজকোর্টের কম্পিউটার অপারেটর মাসুদ রানা ও আইনজীবী সহকারী মো. সোহাগ। গ্রেফতারের পর সোহাগ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সিআইডি থেকে হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এদিকে ৯ জুন বুধবার বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ সিআইডির প্রতিবেদনের শুনানি করেন। পরে অভিযুক্ত দুই আইনজীবী ও কম্পিউটার অপারেটর মাসুদ রানাকে দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছেন।
এছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ২৩ জুন হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম মিতি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
প্রতারণার শিকার বগুড়ার পরিবহণ মালিক আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি হাইকোর্টের কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রতারক এপিপি তানজিম আল মিসবাহর বিরুদ্ধে তার দায়ের করা প্রতারণার মামলা বিচারক শহীদুল ইসলাম আমলে নেন।
তিনি ১০ জুন তার (বাদী) জবানবন্দি ও পরবর্তী আদেশের জন্য হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তার বাবা অসুস্থ থাকায় সময় প্রার্থনা করেছেন।
তিনি আরও জানান, এপিপি তানজিম আল মিসবাহর প্রতারণার কারণে তারা ৩০ জন ৭০ দিন হাজতবাস করতে বাধ্য হয়েছেন। ২৯ জন শ্রমিকের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয়েছে। আমিনুর ওই আইনজীবীর লাইসেন্স বাতিল করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করেছেন। তিনি তাকে আর্থিক, মানসিক ও হয়রানির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।