অশনির প্রভাবে ধান ঘরে তোলা নিয়ে বিপাকে কৃষক

স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে গতকাল সোমবার সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার বোরো চাষিরা। যাদের ধান এখনও কাটা হয়নি এবং কাটার পর ঘরে তোলার অপেক্ষায় মাঠে রয়েছে, সে সকল কৃষক বিপাকে পড়েছেন। অতিরিক্ত মূল্য দিয়েও ধান কাটা মজুর পাচ্ছেন না।
দামুড়হুদা অফিস জানিয়েছে, দামুড়হুদায় মাঠের বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। একযোগ জমির ধান পেকে যাওয়ায় ধানকাটা শ্রমিকের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় একমণ ধানের দরে একজন শ্রমিকের দাম গুনতে হচ্ছে। এতে করে ধান গোছানো নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষকরা।
কৃষি অফিসসূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মরসুমে উপজেলায় ৯ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে ৪০১ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ও ৯৫২৯ হেক্টর জমিতে উফসি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় কৃষকদের ধান ও খুব ভালো হয়েছে। মাঠে ক্ষেতের ধান পেকে সোনালি বর্ণের শীষগুলো ভারে নুইয়ে হেলে রয়েছে। সারা দেশে ঈদের দিন ঝড়-বৃষ্টির আশংখা আবহাওয়া দপ্তর থেকে এমন পূর্বাভাস পাওয়া যায়। এমন পূর্বাভাসের কারনে কৃষকরা ঈদের পর ধান কেটে ঘরে তোলার চিন্তা করে কৃষকরা। গত কয়দিন আবহাওয়া শুস্ক থাকায় ঈদের পরদিন থেকে একযোগে ধান কাটা গোছানোর কাজ শুরু হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে শ্রমিকের। দাম হাকা হচ্ছে ৮০০ থেকে হাজার টাকা।
দামুড়হুদার উপজেলার সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা, সদাবরী কানাইডাঙ্গাসহ এলাকাগুলোয় ধানের আবাদ বেশি হয়ে থাকে। উপজেলার সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল কাদের বিশ্বাস বলেন, তার এবার ৭ বিঘা জমিতে ধান রয়েছে। ধান কাটা শুরু করতে পারেনি। আবহাওয়ার অধিদপ্তরের ঝড়বৃষ্টির পূর্বভাস পাওয়ায় পর ধান কাটা বন্ধ রাখা হয়েছে। ক্ষেতে ধান থাকলেও তেমন ক্ষতি হবে না। ঈদের পরদিন থেকে ধান কাটা চিন্তায় ছিলাম কিন্তু একযোগে ধান কাটা শুরু হওয়ায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না চরমভাবে সংকট দেখা দিয়েছে। ধানের দাম এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা হলে ও বর্তমানে প্রায় এক মণ খানের দরে ৩০০ টাকার শ্রমিক এখন ৮০০ টাকা অনেক শ্রমিক এক হাজার টাকা ও দাম চাচ্ছে তবুও মিলছে না শ্রমিক। একই কথা বললেন কার্পাসডাঙ্গার কৃষক আতিয়ার রহমান তার দুই বিঘা জমিতে ধান রয়েছে। শ্রমিক সংকট দাম ও প্রায় একমন ধানের দরে একজন শ্রমিকের মজুরি তবু ও মিলছে না। এসকল কারণে ধান কাটা গোছানো নিয়ে খুবই দুঃচিন্তায় আছি।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মনিরুজ্জামান মনির বলেন, একযোগে ধান কাটা শুরু হওয়ায় শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে। অনেকে ধান কেটে ফেলেছে কয়েক দিনের মধ্যে চাপ কমলে শ্রমিকের দাম ও কমে যাবে।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগর উপজেলায় এবার বোরো মরসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধান চাষে বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে টানা বৃষ্টি। আর এই টানা বৃষ্টির ফলে জীবননগর উপজেলার বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
গয়েশপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কালাম জানান, তিনি এবছর তিন একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। চাষাবাদের শুরু থেকেই আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ধান গোলায় তুলতে পারবেন, এমন স্বপ্ন দেখছেন তিনি। কিন্তু অসময়ের বৃষ্টি তার সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তিন একর জমির ধানের মধ্যে এক একর জমির ধান বৃষ্টি শুরুর আগে কেটেছেন। বাকিগুলো কাটার সুযোগ পাননি। কিন্তু সোমবারের টানা বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের সম্ভাবনা রয়েছে।
রায়পুর ইউনিয়নের বোরো চাষি আব্দুল খালেক বলেন, সবেমাত্র পাকা ধান কেটে জমিতে রেখে দিয়েছি। ইচ্ছে ছিল জমিতে রেখেই মেশিনের মাধ্যমে ধান মাড়াই করব। এখান থেকে ধান বাড়িতে নিয়ে সিদ্ধ করে শুকাবো এবং খড়গুলো শুকিয়ে সংরক্ষণ করব। কিন্তু আজকের টানা বৃষ্টির কারণে কেটে রাখা পাকা ধান বৃষ্টির পানিতে পড়ে আছে। এছাড়া বাকি যে এক একর জমির ধান কাটতে পারিনি, সেগুলো মাটিতে নুয়ে পড়েছে। ধান পাকা হওয়ায় অনেকগুলো মাটিতে ঝরে পড়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
একই এলাকার কৃষক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, এক একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ধানের গাছ ভেঙে শুয়ে পড়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার টানা বৃষ্টি হয়েছে। অসময়ের এ বৃষ্টির কারণে বোরো ধানের ক্ষেতসহ ফসলি জমিতে পানি জমে গেছে। এতে এখানকার শত শত কৃষক ক্ষেতে থাকা বোরো ধান নিয়ে দুচিন্তার মধ্যে পড়েছেন। ভালো ফলনে মুখে হাসি থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। আবহাওয়া স্বাভাবিক না হলে ক্ষেতের বাকি ধান ঘরে তোলা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তবে অনেকে বৃষ্টি শুরুর আগেই ধান কেটে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
মনোহরপুর ইউনিয়নের ধান চাষি সফিকুল ইসলাম জানান, বৃষ্টির আগে ধান কেটে ক্ষেতের মধ্যে ফেলে রেখেছি। বৃষ্টি শুরুর পর থেকে কাটা ধানগুলো ক্ষেতের মধ্যে পড়ে আছে। ধানের গাছ ভিজে থাকায় মাড়াই করা সম্ভব নয়। এছাড়াও তিনি বলেন, আমাদের এলাকার বেশিরভাগ ক্ষেতের ধান শুয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়া ধান কাটতে সময় বেশি লাগে। ফলে ধান কাটা খরচ বেড়ে যাবে।
এদিকে বৃষ্টিতে ধানের পাশাপাশি খড়ের ক্ষতিরও আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। অনেকে আগাম ধান কেটে খড়গুলো ক্ষেতের মধ্যে শুকাতে দিয়েছেন। তবে বৃষ্টির পানিতে ভিজে থাকার কারণে খড়গুলো পচে যাচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়বে গোখাদ্যের ওপর।
এ বিষয়ের জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার টানা বৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। জীবননগর উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর থেকে আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। সেই সাথে ক্ষতি যতটা কমানো যায় সে ব্যাপারে কৃষকদের সাথে পরামর্শ চলমান রেখেছি।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ক্ষেতের পাকা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য জড়ো করেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষক লাল্টু মিয়া। তবে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে সোমবার দুপুরে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ভিজে যায় সেই ধানের কিছু অংশ। আর বাকি ধান বৃষ্টিতে ভেজার হাত থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে তিনি। তবে ভিজে যাওয়া ধানের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাবে বলে জানান এই কৃষক।
একইভাবে জেলার বিভিন্ন উপজেলার মাঠে মাঠে চলছে বোরো ধান কাটার কাজ। জেলার সাধুহাটিসহ বিভিন্ন এলাকায় বৈরি আবহাওয়ার হাত থেকে ধান রক্ষার জন্য ৮০ ভাগ পেকে গেলেই তা কেটে ফেলার জন্য কৃষকদের সচেতন করতে মাইকিংও করা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কৃষক ক্ষেতের ধান কেটে ঘরে তুলেছেন আবার কারও কারও কাটা ধান রয়ে গেছে ক্ষেতেই। হঠাৎ বৃষ্টিতে অনেক স্থানেই সেই ধান ভিজে গেছে। আর কাটার অপেক্ষায় থাকা ধানগুলো হেলে পড়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি বছর জেলায় বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৮৯ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে ৩২ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে।
জেলা সদরের ভরুয়াপাড়া গ্রামের কৃষক লাল্টু মিয়া বলেন, ১০ কাঠা জমির ধান কেটে রেখেছিলাম বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টিতে কিছু ধান ভিজে গেছে আর কিছু পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছি। ভিজে যাওয়া ধানের মধ্যে পানি লাগার কারণে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
লাউদিয়া এলাকার কৃষক কাইয়ুম হোসেন জানান, রোববার সকালে দুই বিঘা জমির ধান কেটেছেন। কিন্তু সোমবারের বৃষ্টিতে মাঠে কেটে রাখা ধান পানিতে ভিজে গেছে। এভাবে যদি বৃষ্টি হতে থাকে তাহলে কেটে রাখা ধান প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যাবে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, বৃষ্টিতে কেটে রাখা কিংবা পড়ে যাওয়া ধান চারা গজিয়ে কিংবা ঝরে কিছুটা ক্ষতি হবে। তবে যদি বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে কৃষককের ক্ষতির মাত্রা বাড়বে।
এদিকে, বৃষ্টির কারণে শহরের হাটেবাজারে, রাস্তাঘাটে কমেছে মানুষের চলাচল। অলস বসে সময় কাটছে কিছু কিছু দোকানির। কমেছে বেচাকেনা। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না কেউ।

Comments (0)
Add Comment