ঐতিহ্য হারাতে বসেছে অম্রবুচি : বিগত ৪ বছরে সরকার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত

লাবলু রহমান: মিলনের মধ্যে যে সত্য তা কেবল বিজ্ঞান নয়, তা আনন্দ, তা রস স্বরূপ, তা প্রেম। তা আংশিক নয় তা সমগ্র, কারণ তা কেবল বুদ্ধিতেই নয়, তা হৃদয়কেও পূর্ণ করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমোঘ বাণীর কথা মনে করিয়ে দেয় পয়লা আষাঢ়। প্রতিবছর যে মেলা মানুষের মনে দাগ কাটে। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিগত ৪ বছর বসেনি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক মেটেরি মেলা। হ্যাঁ বলা হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি অম্রবুচি মেটেরি মেলার কথা। দেশখ্যাত এ গ্রামীণ মেলা মানুষের হৃদয় থেকে যেন ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে।
মেলার আক্ষরিক অর্থ হলো মিলন। মেলা মানেই সবার মনে অভূতপূর্ব আনন্দের এক উচ্ছ্বাস। এর স্মৃতি থাকে সকলের মনে গভীরভাবে মুদ্রিত। মেলা মানেই পরস্পরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও ভাব সম্মিলনে সংযোগ সেতু। প্রাচীনকাল থেকেই তাই এর মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল অসীম। মানুষের মনের খুরাক নিবারণ, সরকারি রাজস্ব বন্ধসহ অর্থনৈতিক একটা অংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অশ্লীলতার ভয়াল থাবায় গ্রাস হয়েছে মেলার ঐতিহ্য যার কারণে অধিক মূল্যে মেলার ইজারা নিতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ইজারাদাররা। মাত্রাতিরিক্ত অশ্লীলতা ও ব্যহায়াপনার কারণে স্থানীয়দের মধ্যেও রয়েছে মেলা নিয়ে বিতৃষ্ণা। কালের পরিক্রমায় শত বছরের এ ঐতিহ্য ভুলুণ্ঠিত হতে চলেছে। তবে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে গ্রামীণ মেটেরি মেলা অশ্লীলতা মুক্ত সুস্থ সংস্কৃতির স্বাভাবিক ধারায় পুনরায় ঐতিহ্য ধরে রাখার কথা বলছেন সুধীমহল। যদিও বর্তমানে মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে জনসমাগম তথা মেলার কোন যৌক্তিকতা নেই।
অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। গৌরবময় সেই উত্তরাধিকার চুয়াডাঙ্গা জেলাও বহন করে চলেছে। এখানকার লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। এক সময় মুর্শিদী, মারফতি, যাত্রা, ভাসান, কবিগান, কীর্তন, জারি গান, গাজারি গীত, গাজনের গান, মাদার পীরের গান, মেয়েলি গীত, বিয়ের গান, কৃষকের মেঠোগান, প্রভৃতি গ্রামগুলো মুখরিত করে রাখতো। এ জেলা মুসলমান ফকির ও বাউলপন্থী হিন্দু বৈষ্ণব প্রমুখের ধর্ম সাধনার একটি কেন্দ্রস্থল। লালনের বহুসংখ্যক অনুসারী ও গোসাই গোপাল ও অপরাপর অনেক বাউলপন্থী রসিক বৈষ্ণবের বাস ও বিচরণ স্থান এই চুয়াডাঙ্গা।
কথিত আছে, হযরত খাজা মালিক উল গাউস (রা.) (মল্লিক শাহ্) একজন সাধক ছিলেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা গড়াইটুপি গ্রামে একটি নির্জন মাঠে আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখান থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করতেন। তৎকালীর রাজা গৌরগোবিন্দ নামের হিন্দু শাসকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় প্রচারক হিসেবে এই এলাকায় পীর পরিচিতি লাভ করেন। রাজা গৌরগোবিন্দের করারোপের বিরুদ্ধে ও ধর্মীয় প্রচারক হিসেবে সমাদৃত হন।
সেখানে তিনি বাংলা সনের ৭ আষাঢ় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গড়াইটুপি গ্রামের মাঠের মধ্যে তার মাজার আছে। প্রতিবছর ৭ আষাঢ় হযরত খাজা মালিক-উল-গাউস (রা.) স্মরণে ৭ দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যা মেটেরি মেলা নামে পরিচিত।
আজ মঙ্গলবার ১ আষাঢ়। আষাঢ়ের সাথে অম্রবুচি মেটেরি মেলার যেন আত্মার সম্পর্ক। প্রতিবছর আলিঙ্গনে এ সম্পর্কে অনেকটা দূরত্ব বেড়েছে বেশ কয়েকবছর। বিগত প্রায় ৪ বছর মেলার আয়োজন নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বন্ধ রয়েছে। আর এর থেকে সরকারি কোষাগারে প্রায় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বিনা পারিশ্রমিকে দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে মাজার শরিফের খেদমত করছেন গড়াইটুপি গ্রামের মৃত খোদাবক্স ম-লের ছেলে মোয়াজ্জেম আলী। তিনি বলেন, আমি চিশতিয়া তরিকার দীক্ষা নিয়েছি। দূর দুরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসে। রোববার আর বৃহস্পতিবার মানুষ বিভিন্ন মান্নত শোধ করে থাকেন। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন এই মাজার শরিফের খেদমতে নিজের জীবন উৎসর্গ করব ইনশাআল্লাহ।
এ বিষয়ে স্থানীয় গড়াইটুপি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান রাজু বলেন, এই গ্রাম আমার জন্মস্থান। আমাদের এই মেটেরি মেলার সুনাম সারাদেশ ব্যাপী। ঐতিহ্যবাহী মেটেরি মেলা কয়েক বছর ধরে নানা সমস্যার কারণে সরকারি ইজারা কেউ নেয়নি। বর্তমানে প্রাকৃতিক মহামারীর কারণে মেলা নিয়ে সম্ভাবনা নেই। তবে ইনশাআল্লাহ এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটলে গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। আমাদের সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই মেটেরি মেলা বিশেষ অবদান রাখে। নোংরামি অশ্লীলতার আগ্রাসনে মেলাটি আজ বিলুপ্তির পথে। নোংরা মানসিকতা পরিহার করে মেটেরি মেলার হারানো এতিহ্য ফিরে পেতে আমরা সরকারের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানাই। ভবিষ্যতে আমাদের পক্ষ থেকে মেটেরি মেলার ঐতিহ্য ফেরাতে সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে। তবে এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে এখানে একটি সাপ্তাহিক পশুহাট বসানোর চিন্তা ভাবনা আছে। এ বিষয়ে আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছি। এতে করে একদিকে এখান থেকে সরকার রাজস্ব পেত, অন্যদিকে অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। সেই সাথে মেটেরি মেলা হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতো। বহু বছর আগে এখানে হাট বসতো। তাই উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিষয়টি সরকারের সুনজরে নেয়ার আহবান জানান তিনি। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, আমি যখন ডিসি হয়ে জেলাতে যোগদান করি তারপর থেকে এ পর্যন্ত মেলা দেখার সুযোগ হয়নি। আমি মেলাটির ব্যাপারে শুনেছি। নানা কারণে মেলা বন্ধ হয়ে আছে। এটা আমাদের গ্রাম বাংলার একটা ঐতিহ্য। গ্রামীণ মেলা হলো গ্রামের মানুষের সঙ্গে মনের ও অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি কখনো ভালো হলে মেলার হারানো এতিহ্য ফেরানোর ব্যাপারে ভেবে দেখবো। বর্তমানে মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। জনসমাগম হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না। পরিস্থিতি ভালো হলে আগামীতে এ বিষয়ে আমরা প্রশাসনিকভাবে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখবো।

Comments (0)
Add Comment