ঘুরে ফিরে পুরোনো প্রস্তাবে ফিকে তিন দিনের ডিসি সম্মেলন

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার নির্দেশ
স্টাফ রিপোর্টার: জাতিসংঘ মিশনে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাঠানোর প্রস্তাব আগের একাধিক ডিসি সম্মেলনেও এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং অনুবিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো ফল মেলেনি। অন্যদিকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় ফৌজদারি অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা চেয়েও একাধিকবার প্রস্তাব এসেছে। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান। তারপরও এবারের ডিসি সম্মেলনে এ প্রস্তাব কার্যপত্রে রাখা হয়েছে। এভাবে ঘুরে ফিরে পুরোনো প্রস্তাব আসায় ডিসি সম্মেলনে আগের মতো বৈচিত্র্য থাকছে না বলে মনে করছেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। এবারের ডিসি সম্মেলনে মোবাইল কোর্ট আদালতের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে দ-বিধি-১৮৬০-এর ২২৮ ধারা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব দিয়েছেন নাটোরের ডিসি। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার জাতিসংঘ মিশনে প্রশাসন ক্যাডার অফিসারদের সুযোগ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া ইটভাটা ও করাতকল ব্যবস্থাপনা, গ্রাম পুলিশের বেতন বৃদ্ধি, জেলা পর্যায়ে অ্যাটর্নি সার্ভিস, পলিথিন সমস্যা, পাহাড় কাটা, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে বিগত বিভিন্ন বছরের ডিসি সম্মেলনে প্রস্তাব এসেছে। অথচ চোরাচালান, সীমান্তে মানুষ হত্যা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অথচ কোথাও নেই। মাঠপর্যায়ে এ মুহূর্তে বড় সমস্যা দুর্নীতি। কিন্তু প্রস্তাবে স্থান পায়নি দুর্নীতির বিষয়। অনেক জেলা প্রশাসক মনে করেন তারা সম্মেলনে মন খুলে কথা বলতে পারেন না। এখানে ক্লাসরুমের মতো চুপচাপ বসে থাকতে হয়। ক্রিয়েটিভিটির তেমন কিছু নেই। বছরের পর বছর প্রায় একই ধরনের অনেক প্রস্তাব ডিসি সম্মেলনে আসার পরও এগুলো কার্যপত্রে রাখা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন খোদ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা। কিন্তু সরকারি চাকরিতে থাকায় তারা কেউ নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিন বছরের বেশি সময় ডিসি ছিলেন, বর্তমানে সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিসি সম্মেলনের গতানুগতিক এ ধারা ভাঙার সময় এসেছে। তিনি বলেন, এক সময় জেলা থেকে ঢাকায় ঠিকমতো টেলিফোন লাইন পাওয়া যেত না। যাওয়া-আসা করতে সারা দিন লেগে যেত। এখন ১ ঘণ্টার নোটিশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বা মুখ্য সচিব চাইলেই ৬৪ জেলার ডিসিদের নিয়ে বৈঠকে বসতে পারছেন। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত বিষয়গুলো কেন ডিসি সম্মেলনের কার্যপত্রভুক্ত করতে হবে, তা বুঝে আসে না। সাবেক ডিসি ও বর্তমানে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন এমন এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের অন্তত দেড় ডজন জেলার সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত আছে। সেখানকার চোরাচালান, মানুষ হত্যা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। গত বছর দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে, এমন প্রতিবেদন মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন হয়েছে। ডিসিরা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হলেও এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন ও জলমহাল নিয়ে জেলা প্রশাসন নাজেহাল হন। কিন্তু এরপরও এ বিষয়ে তাদের কোনো প্রস্তাব কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয় না। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। জেলায় জেলায় তাদের সরকারি ও বেসরকারি সফরে প্রটোকল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। এটা বড় সমস্যা হলেও কর্মকর্তারা প্রস্তাব দিতে সাহস পান না। তিনি বলেন, সম্মেলনে এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত। অন্যথায় প্রতিবারই পুরোনো বিষয়ে প্রস্তাব আসবে।
অন্যদিকে সম্মেলনে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে যে ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয় তা বলার জন্য বলা বলেও মনে করেন অনেক জেলা প্রশাসক। উদাহরণ দিয়ে সম্মেলনে অংশ নেওয়া এক ডিসি বলেন, পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি বন্ধে ডিসিদের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন একজন মন্ত্রী। ট্রাকে চাঁদাবাজি কারা করেন সেটা রাজনীতিবিদরা যেমন জানেন, অন্যরাও জানেন। যাদের দিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে তারাই এসবের সঙ্গে যুক্ত। আবার তাদের পুরোপুরি কর্তৃত্ব ডিসিদের হাতে নেই। তাহলে ডিসিরা কিভাবে এখানে উদ্যোগ নেবেন এবং সফল হবেন। এ সম্মেলন বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক ডিসি ও বর্তমানে অবসরে থাকা জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচনা কী নিয়ে হবে না হবে তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে ডিসি সম্মেলনের প্রয়োজন আছে। এখানে নীতিনির্ধারকরা জেলা প্রশাসকদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন। যা তাদের স্থানীয় প্রশাসন চালাতে অবদান রাখে। এছাড়া এক জেলার ডিসির সঙ্গে অন্য জেলার ডিসিদের দেখা হয়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময়ের কারণে নিজেদের অভিজ্ঞতা বাড়ে। একইসঙ্গে নতুন ডিসিরা অভিজ্ঞ ডিসিদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারেন। প্রতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ডিসি সম্মেলনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সব জেলার ডিসিদের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ডিসিদের পাঠানো প্রস্তাব যাছাই-বাছাইয়ের পর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাই ডিসি সম্মেলনে প্রস্তাব কী কী উঠবে তা নির্ভর করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওপর। একই বিষয় বারবার কেন ডিসি সম্মেলনের কার্যপত্রে রাখা হয়, এমন প্রশ্নের খোঁজে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এক কর্মকর্তা বলেন, ডিসিদের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আগের প্রস্তাবের সঙ্গে তুলনা করা হয় না। ফলে এক ধরনের বিষয়ই ঘুরেফিরে বিভিন্ন বছরে উঠছে। আবার এ সংক্রান্ত দায়িত্বে নতুন অফিসাররা এলে আগের বিষয়গুলো তাদের জানা থাকে না।
অন্যদিকে চার ডিসির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়। এক ডিসি বলেন, সম্মেলনে প্রস্তাব পাঠানোর ক্ষেত্রে ইউএনওদের মতামত চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে একটি তালিকা করে পাঠানো হয় ঢাকায়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ নতুন ডিসির দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এ ধরনের প্রস্তাবে কী পাঠাতে হবে তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে যেমন-তেমন বিষয় পাঠিয়ে দায়িত্ব সারেন। অপর ডিসি বলেন, সম্মেলনে গিয়ে শুধু ক্লাসরুমের মতো বসে থেকে বয়ান শুনতে হয়। এখানে ক্রিয়েটিভ কিছু করার সুযোগ নেই। তাই প্রস্তাব পাঠানোতেও তেমন খাটাখাটি করতে কেউ রাজি হন না। একইসঙ্গে প্রকৃত অনেক সমস্যার প্রস্তাব চূড়ান্ত কার্যপত্রে জায়গা পায় না। সম্মেলনের অধিবেশন চলাকালেও ভিন্ন কোনো বিষয়ে বক্তব্য দিতে দেওয়া হয় না। ডিসিদের এমন বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্মেলন উপলক্ষ্যে দেওয়া ১৯ দফা নির্দেশনায়। এবারের সম্মেলন শুরুর আগের দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ডিসিদের উদ্দেশ্যে নির্দেশনার ছয় নম্বরে বলেছেন, ‘কার্যপত্রে উল্লিখিত প্রস্তাবের বাইরে কোনো সম্পূরক প্রশ্ন না করাই কাম্য।’ সাত নম্বরে, ‘সরকারি নীতির বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য উপস্থাপন না করার বিষয়ে বলা হয়েছে। মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার তিন দিনব্যপী ডিসি সম্মেলন ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সঙ্গে ভার্চুয়ালি সৌজন্য সাক্ষাতের সেশন হয়েছে ডিসিদের।
করোনা নিয়ন্ত্রণে ডিসিদের সহযোগিতা চাইলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী: দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের ১১ দফা নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য মাঠপর্যায়ে নজদারি বাড়াতে প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সহযোগিতা দরকার। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থার নির্দেশ দেবেন তারা। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের তৃতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে অংশগ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাস বাড়ছে, সরকার আতঙ্কিত না হলেও চিন্তিত। এটি নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। তবে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে না তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি। আগে যে ধরনের সহযোগিতা জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পেয়েছি। সে ধরনের সহযোগিতা আগামীতেও পাব বলে আশা করছি। তাদের সহযোগিতা দরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে হলে আমাদের অবশ্যই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পাশাপাশি টিকা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এ কার্যক্রমেও ডিসিরা সহযোগিতা করছেন। তবে অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সব মানুষকে টিকার আওতায় আনতে জেলা প্রশাসকদের আরও সহযোগিতা দরকার। এক মাসের মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে টিকা আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভ্যাক্সিনেশন কমপ্লিট। যারা বাকি রয়েছেন তাদেরও দ্রুত টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে। জেলা প্রশাসকরা কোনো দাবি জানিয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে একটি করে ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণে ডিসিদের দাবি ছিল। সেই বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোর নির্মাণ কাজ চলমান। কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আটটি হাসপাতাল উদ্বোধন করেছেন, যার একেকটি সাড়ে ৪০০ শয্যার। এখানে ক্যানসার, কিডনি ও হার্টের রোগের চিকিৎসা হবে। সামনেও এমন হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি।’ এছাড়া নদী দূষণে জড়িত শিল্প-কারখানার দিকে নজর দিতেও জেলা প্রশাসকদের আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ নদী, পানি দূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। এ পানি যারা ব্যবহার করছেন, তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই বিষয়ে নজর দিতে হবে।

Comments (0)
Add Comment