ঝিলিক সেবন করে ঘুমের বড়ি : এরপর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে স্বামী : এরপর সাজায় দুর্ঘটনার নাটক

স্বামীর পরকীয়ার সম্পর্ক আছে-এই সন্দেহ থেকে ঝিলিক ১০ টি ঘুমের ট্যাবলেট সেবন করেন। এর মধ্যে স্বামী সাকিবুল আলম মিশু শরীরে ৫ টি মরফিন ইনজেকশন নেয়। এরসাথে ২ টি ঘুমের ট্যাবলেট সেবন করে। বিছানায় শুয়ে থাকার সময় পাশেই অনেকটা বেহুস অবস্থায় শুয়ে থাকে তার স্ত্রী ঝিলিক। ঘুমের মধ্যেই ঝিলিক বলতে থাকে, ‘তুমি মেয়ে নিয়া ঘুরতে গেছিলা।’ মিশু তখন তার মাথার নিচের দুইটি বালিশ নিয়ে ঝিলিকের মুখে চেপে ধরে। প্রায় ১ মিনিট ধরে চেপে রাখার পর ঝিলিকের মুখ থেকে কথা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই গত ২ এপ্রিল শুক্রবার রাত ২ টার দিকে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের ৩৬ নম্বর সড়কের ২২/সি নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে গৃহবধূ ঝিলিক আলমকে হত্যা করা হয়। হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর মিশু গৃহকর্মীদের সহায়তায় ঝিলিকের লাশ বাড়ি থেকে বের করে গাড়িতে তোলে। গাড়িটি হাতিরঝিল এলাকায় রোড ডিভাইডারে ধাক্কা দিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজায়। পরবর্তীতে ঝিলিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা জানায় আগেই ঝিলিকের মৃত্যু হয়েছে। এরপর পুলিশ মিশুকে গ্রেফতার করে। ২ দিনের পুলিশী রিমান্ডে থাকার পর গত ১১ এপ্রিল সাকিবুল আলম মিশু ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলামের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

পরকীয়ার সন্দেহ ছিল স্বামীর প্রতি

ধনীর দুলাল সাকিবুল আলম মিশু দীর্ঘ দিনের নেশাখোর। মাদকাসক্ত। গুলশানের নিজেদের ফ্ল্যাটে মিশু, তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম, মা সাইদা আলম, ছোট ভাই ফাহিম আলম ও ফাহিমের স্ত্রী টুকটুকি বসবাস করেন। বাসায় সার্বক্ষণিক থাকেন দুইজন গৃহকর্মী। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে মিশুর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় তার। পরে প্রেম হয়। মিশু বাবা-মায়ের কাছে পছন্দের বিষয়টি জানালে তারা ঝিলিকের পারিবারিক বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বিয়েতে অমত দেন। কারণ, ঝিলিক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মিশু ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। মিশু তাকে ছাড়া অন্য মেয়েকে বিয়ে করবেন না বলে জানিয়ে দেন। একপর্যায়ে ছেলের পছন্দে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। কয়েক মাস তারা ভালোই ছিলেন। ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে শুরু হয় অশান্তি। বিয়ের পর মিশুর বাবা-মা ও ভাইবোন নির্যাতন শুরু করেন। উঠতে-বসতে তারা ঝিলিককে ‘গরিবের মেয়ে’ বলে গালমন্দ করতেন। নির্যাতনও করা হতো। মিশুর ছোট ভাই ফাহিমের স্ত্রী টুকটুকি ছিলেন উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। ২০১৯ সালের জুনে ঝিলিককে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। মাদকাসক্ত ও বেকার যুবক মিশু প্রায়ই ঝিলিককে মারপিট করতেন। দেড় মাস পর আগস্টের শুরুর দিকে মিশুকে খিলগাঁওয়ের একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়। এ খবর পেয়ে ঝিলিক তাজমহল রোডের বাবার বাসা থেকে গুলশানে শ্বশুরবাড়িতে যান। কিন্তু শাশুড়ি তাকে বাসায় ঢুকতে দেননি। পরে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানান ঝিলিক। গুলশান থানা পুলিশ সেখানে যায়। তবে শাশুড়ির বাধার মুখে তাকে বাসায় ঢোকাতে পারেনি পুলিশ। ২৪ দিনের মাথায় ঝিলিক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে স্বামীকে নিয়ে গুলশানের শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন। এরই মধ্যে ঝিলিক বুঝতে টের পান যে তার স্বামীর সঙ্গে ফেসবুকে স্বর্ণালী সারাহ নামে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে মিশু তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাত। ঝিলিক তখন বুঝতে পারেন যে সংসার টিকিয়ে রাখতে সন্তান গ্রহণ করতে হবে। ঝিলিক অন্তঃসত্ত্বা হন। গত বছরের জুলাইয়ে তারে কোলে আসে আয়মান নামে ফুটফুটে সন্তান।
যেভাবে ঝিলিককে হত্যা করা হয় :
আদালতে মিশু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ঝিলিক তার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক থাকার বিষয়ে সবসময় সন্দেহ করত। ঘটনার দিন ২ এপ্রিল রাতে মিশু ময়মনসিংহের ভালুকায় তাদের ফার্ম হাউস দেখতে যায়। সঙ্গে ছিল তার বন্ধু সোয়াদ, তামিম ও দীপন। ব্যক্তিগত গাড়িটি মিশু নিজেই চালায়। ঝিলিকের মধ্যে সন্দেহ হয় যে মিশু একজন নারীকে নিয়ে ভালুকায় যাচ্ছে। এ কারণে ঝিলিক ৫ মিনিট পরপর মিশুর মোবাইলে ভিডিও কল দেয়। ভিডিও কলে ঝিলিক মিশুকে দেখিয়ে ১০ টি ঘুমের ওষুধ সেবন করে। এটা দেখে মিশু ভালুকা যাওয়া বাতিল করে গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকায় ফেরে। এরই মধ্যে মিশুর মা ফোন করে বলেন, ঝিলিক তার ছেলে আয়মানকে কাজের মেয়ের কাছে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। রাত ১ টার দিকে মিশু গুলশান এলাকা থেকে তালা খোলার একজন মিস্ত্রিকে সাথে নিয়ে বাসায় যান। সেখানে বেডরুমের দরজার তালা ভেঙ্গে দেখতে যান ঝিলিক অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। ঝিলিককে উদ্ধার করে গাড়িতে করে সেন্ট্রাল হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু মিশু সুইসাইড কেস হতে পারে ভেবে ভয় পেয়ে ঝিলিককে বাসায় নিয়ে আসে। ঝিলিককে গোসল করিয়ে দিয়ে তরমুজের জুস খাওয়ায়। এরপর ঝিলিককে বিছানায় শুইয়ে দেয়। রাত ২ টার দিকে মিশু ৫ টি মরফিন ইনজেকশন নেয়। এরপর ২ টি ঘুমের ওষুধ সেবন করে। বিছানায় ঝিলিকের পাশে শুয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ঘুমের মধ্যেই ঝিলিক বলতে থাকে, ‘তুমি মেয়ে নিয়া ঘুরতে গেছিলা।’ মিশু তখন তার মাথার নিচের দুইটি বালিশ নিয়ে ঝিলিকের মুখে চেপে ধরে। প্রায় ১ মিনিট ধরে চেপে রাখার পর ঝিলিকের মুখ থেকে কথা বন্ধ হয়ে যায়। মিশু ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল ৭ টার দিকে মিশুর মায়ের ডাকাডাকিতে তার ঘুম ভাঙ্গে। পাশে দেখে যে ঝিলিক শুয়ে আছে। তার মা ঝিলিকের শরীর ধরে বলেন যে ওর শরীর একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে। এরপর মিশু তার ম্যানেজারের সহায়তায় ঝিলিককে গাড়িতে তোলে। গাড়ির পিছনের সীটে ঝিলিককে শুয়ে রাখা হয়। হাতিরঝিলে আসার সময় গাড়িটি রোড ডিভাইডারে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর ঝিলিককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান যে আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।

 

 

 

Comments (0)
Add Comment