স্টাফ রিপোর্টার: এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ ঘোষণা করতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে তাগিদ দিয়েছে বিএনপি। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে দুই ছাত্র উপদেষ্টা (মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া) এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে (ড. খলিলুর রহমান) বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনেরও দাবি জানিয়েছে দলটি। গতকাল শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধিদল এই দাবি জানায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির আরো তিন জন সদস্য— ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ। আর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় যমুনায় প্রবেশ করে বিএনপির প্রতিনিধিদল। রাত পৌনে ৯টায় বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, যে কোনো অছিলায় নির্বাচন যত বিলম্ব করা হবে, আমরা মনে করি স্বৈরাচার পুনরায় ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এর দায়দায়িত্ব তখন বর্তমান সরকার এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর বর্তাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা। বিএনপি প্রথম থেকেই একটি সুস্পষ্ট জাতীয় নির্বাচনি রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে। ড. মোশাররফ বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, এই তিনটি বিষয়ের একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সম্পর্ক নেই। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটা চলতে থাকবে। সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার সংস্কারের প্রস্তাব দেবে, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সেটি গৃহীত হবে এবং সেটা চলমান থাকবে। জনগণ যদি আগামীতে বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়, তখনো আমরা সেটা অব্যাহত রাখব। গণহত্যার বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এজন্য আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি সবচেয়ে বেশি বিএনপির। এই বিচারপ্রক্রিয়া কোনোভাবে অসম্পন্ন থেকে গেলে বিএনপি সরকারে গেলে তা বিচারের আওতায় এনে স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে। এই সরকারকে প্রথম দিন থেকেই আমরা বলে আসছি, বিএনপি ফ্যাসিবাদের ও গণহত্যাকারীদের বিচার চায়। গণহত্যাকারীদের বিচারকাজ চলমান থাকবে। যতটুকু বাকি থাকবে তা নির্বাচিত সরকার করবে। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, তারা কখনোই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চাননি, বরং প্রথম দিন থেকেই এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মূলত সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন এই তিনটার ওপর আলোচনা হয়েছে। সংস্কারের বিষয়ে আমরা পরিষ্কার এবং ওনারা একমত হয়েছেন, সংস্কার যেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়ার কথা, তার ভিত্তিতে সংস্কারকাজ সম্পন্ন হবে। সেই কাজ অতি সহসা সম্পন্ন করা সম্ভব। এখানে কোনো দ্বিমত পোষণ করেননি। বিচারব্যবস্থা বিচার বিভাগ করবে এবং বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে যে আলোচনা হয়েছে, এখানে ওনাদের কোনো দ্বিমত নেই। সুতরাং, ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন করা সম্ভব। এই আলোচনাও হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, এখন প্রতিক্রিয়া জানানোর দরকার নেই। ওনাদের (প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর) সংবাদ সম্মেলনে কী বলে, তারপরে আমরা প্রতিক্রিয়া দেব। ওনার (প্রধান উপদেষ্টার) প্রেসকে আগে কথা বলতে বলবেন। সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, বৈঠকে আমরা বিতর্কিত দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে বাদ দেয়ার কথা বলেছি। পদত্যাগের ব্যাপারে আমরা লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছি। আগেও জানিয়েছি নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং দুজন ছাত্র উপদেষ্টা, যাদের কারণে এই সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাদের বাদ দেওয়ার আজকেও লিখিত বক্তব্যে দিয়েছি। মুখেও বলেছি। এ বিষয় কোনো আশ্বাস পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশ্বাস দিয়েছেন, ওনারা দেখবেন। আমরা আমাদের বক্তব্য দিয়েছি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, আমরা বলেছি- সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত নয়। দেশে এখন যে অবস্থা, আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি, একমাত্র দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমেই জাতিকে এখান থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। এজন্য আমরা বৈঠকে দ্রুত নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার কথা বলেছি। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের চিন্তা করছেন—এমন খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে তা নিয়ে সারা দেশে চলছে নানামুখী আলোচনা, বিশ্লেষণ। বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ রাজনৈতিক দলগুলোও এ নিয়ে নিজেদের মতো করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল রাতে যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে।