পেঁয়াজ কারসাজিতে অসাধুদের পকেট ভারি : লোপাট ৪২৪ কোটি

৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ উঠেছে ১২০ টাকায়
স্টাফ রিপোর্টার: দেশে পেঁয়াজের মজুদ আছে সাড়ে তিন মাসের। মোকাম থেকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতিও একেবারে স্বাভাবিক। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে পেঁয়াজের বাজার এখনও অস্থির। ওই চক্রটির অজুহাত-ভারত রফতানি বন্ধ করায় সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতির। যদিও দেশটির রফতানি বন্ধের ১৫ দিন আগ (৩১ আগস্ট) থেকেই পেঁয়াজের দামে ঊর্ধ্বগতি, যা এখনও অব্যাহত। এতে ১৮ দিনের ব্যবধানে ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ উঠেছে ১২০ টাকা। ওই সময়ে গড়ে সর্বনিম্ন ১২ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজিতে বাড়তি মুনাফা তুলে নেয়া হয়েছে ভোক্তার পকেট থেকে। প্রতিদিন কেজিতে গড়ে নেয়া হয়েছে ৪২ টাকা করে। দেশে গড়ে পেঁয়াজের প্রতিদিনের চাহিদা রয়েছে ৬ হাজার ৯৪৪ টন বা ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৪ কেজি। এ হিসাবে ১৮ দিনে মোট ৪২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ওই ১৮ দিনে ৬টি ধাপে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে বাজারে ক্রেতা না-থাকা এবং সরকারের নানা উদ্যোগে গত বুধবার থেকে নিত্যপণ্যটির দাম কমতে শুরু করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার আগের দু’দিনের তুলনায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে কেজিতে গড়ে ২০-৩০ টাকা কমেছে। এদিন পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজি বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০-৬৫ টাকা। এছাড়া খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজি বিক্রি হয়েছে ৮৫-৯০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০-৭৫ টাকা। প্রসঙ্গত, গত বছরের একই সময়েও ভারত পেঁয়াজ রফতানি মূল্য বাড়িয়ে দিলে দেশে এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। পরে রফতানি বন্ধ করে দিলে দাম আরও বেড়ে যায়। ওই সময়ও পেঁয়াজের সরবরাহ ও মজুদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো। তারপরও দাম বেড়েছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। প্রতি কেজির দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ৩২০ টাকায় উঠেছিলো। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ২৪ দিনে অসাধু সিন্ডিকেটটি ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। সে বছর কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে এ বছরও একই সিন্ডিকেট সুযোগ পেয়ে দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও মজুদ থাকার পরও ভারত রফতানি বন্ধ ঘোষণার পর বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে।
জানতে চাইলে কনজুমার ইয়ুথ বাংলাদেশের (সিওয়াইবি) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, গত বছরের পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করা চিহ্নিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না হওয়ায় এবারও তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ ১৫ থেকে ১৬ দিনে কোনো কারণ ছাড়া পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। তারপরও এই চক্রের সদস্যারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গত বছর দেশে পেঁয়াজ নিয়ে লঙ্কাকা- ঘটানোর পর সিওয়াইবি’র পক্ষ থেকে একটি জরিপ করা হয়েছিলো। সেখানে সিন্ডিকেটের সদস্যরা কীভাবে ভোক্তার পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলো, তা আমরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলাম। এবারও একটি জরিপ করা হচ্ছে। তবে জরিপের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন না হওয়ায় আমরা এবার এখনও সংবাদ সম্মেলন করতে পারছি না। তবে প্রাথমিকভাবে বলা যায়, এবার পেঁয়াজকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারের নাকের ডগার উপর দিয়ে শক্তিশালী সেই পুরোনো সিন্ডিকেট শত শত কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।
অসুন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বাজারে ৩০ আগস্ট প্রতি কেজির দাম ছিলো ৪০ টাকা। ৩১ আগস্ট থেকে দাম বাড়তে থাকে। ওইদিন কেজিতে দাম ১২ টাকা বেড়ে হয় ৫২ টাকা। ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দরে পেঁয়াজ বিক্রি হয়। দেশে প্রতিদিন পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার ৯৪৪ টন বা ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৪ কেজি। এ হিসাবে আলোচ্য ৩ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে নেয়া হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। ৩ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের দাম আরও এক দফা বেড়ে প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ৫৫ টাকা। ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দাম স্থির ছিলো। ওই ২ দিন ভোক্তার পকেট থেকে প্রতি কেজিতে মুনাফা নেয়া হয়েছে ১৫ টাকা করে। এ হিসাবে ২ দিনে মোট নেয়া হয়েছে ২০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ৫ সেপ্টেম্বর তা আরও এক ধাপ বেড়ে হয় ৭০ টাকা কেজি। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দরেই বিক্রি হয়। আলোচ্য ৯ দিনে প্রতি কেজিতে মুনাফা নেয়া হয়েছে ৩০ টাকা করে। ফলে ওই সময়ে মোট মুনাফা নেয়া হয়েছে ১৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে ১৪ সেপ্টেম্বর সোমবার ভারত রফতানি বন্ধ করলে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে ৮৫ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই দর একদিন স্থির ছিলো। ওইদিনে প্রতি কেজিতে ভোক্তার পকেট থেকে বাড়তি নেয়া হয়েছে ৪৫ টাকা। এ হিসাবে একদিনে নেয়া হয়েছে ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের বাজারে রীতিমতো আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে প্রতি কেজির দাম ওঠে ১২০ টাকা পর্যন্ত। এই একদিনে প্রতি কেজিতে বাড়তি নেয়া হয়েছে ৭০ টাকা। এ হিসাবে নেয়া হয়েছে ৪৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর দাম কিছুটা কমে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৯০-১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আলোচ্য ২ দিনে প্রতি কেজিতে গড়ে বাড়তি মুনাফা নেয়া হয়েছে ৮০ টাকা করে। এ হিসাবে ওই সময়ে মোট মুনাফা নেয়া হয়েছে ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। এ হিসাবে ৩১ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ১৮ দিনে ৬ ধাপে প্রতি কেজি পেঁয়াজে দাম সর্বোচ্চ ৮০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ হিসাবে গড়ে ১৮ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে অসাধু ব্যবসায়ীরা লোপাট করেছেন প্রায় ৪২৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থকে বলা হচ্ছে, দেশে উৎপাদন ও আমদানি মিলে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও মজুদ রয়েছে। তাই পণ্যটির কোনো ধরনের সংকট নেই। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য আবু রায়হান আলবেরুনী বৃহস্পতিবার বলেন, বর্তমানে দেশে সাড়ে ৫ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ মজুদ আছে। এই পেঁয়াজ দিয়ে আরও তিন মাস বা সাড়ে তিন মাস চলবে। এছাড়া আমদানি করা যেসব পেঁয়াজ আছে তা আগের চেয়ে কম দরে এলসি করা। সেক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধি করা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।
বিআইডিএস’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বিক্রেতারা সুযোগ পেলেই কারসাজি করে। তারা বেশি দামের আশায় পেঁয়াজ দুই থেকে তিন দিন পণ্য ধরে রেখে বিক্রি করে। এজন্য বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এছাড়া যেসব ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা আছে তারা আবার চাহিদার তুলনায় বেশি করে কিনে, তারা ভাবেন সামনে দাম আরও বেড়ে যাবে। এতে বাজারেও পণ্যটির সরবরাহ কমে। ফলে সুযোগ পেয়ে অসাধুরা আরও দাম বাড়ায়, যা কোনোভাবেই ঠিক না।
সরকারের উদ্যোগ: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এক মাসের মধ্যে পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এছাড়া চাহিদা মোতাবেক বাজারে পেঁয়াজের মজুদ, সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- পেঁয়াজ রফতানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে কুটনীতিক মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য পররাষ্ট্র সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমদানিকৃত পেঁয়াজ স্থলবন্দর থেকে দ্রুততম সময়ে ছাড় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এনবিআরের চেয়ারম্যান এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানির ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আপাতত প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। এদিকে পেঁয়াজ আমদানির ওপর এলসি মার্জিন শিথিল করা হয়েছে। শূন্যতম এলসি মার্জিন রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

Comments (0)
Add Comment