ইতিহাসে এমন কিছু নাম রয়ে যায়, যাদের জীবন শুধু ব্যক্তিগত কীর্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং পুরো একটি সমাজ, একটি জাতি এবং একটি সভ্যতার ওপর রেখে যায় গভীর প্রভাব। সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি ও সিনিয়র স্কলারস কাউন্সিলের প্রধান শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ ছিলেন তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব।
টানা ছাব্বিশ বছর তিনি ছিলেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ। ২৩ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হতেই মুসলিম বিশ্বের এক বিরাট অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। তার বিয়োগে মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে যে ক্ষত তৈরি হলো তা কোনো দিন মোছার নয়।
১৯৪৩ সালের ৩০ নভেম্বর মক্কার পবিত্র মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মেছিলেন আলে শায়খ পরিবারের উত্তরসূরি হয়ে-যে পরিবার ইমাম মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের ধারক ও বাহক। পরিবারের আলো তার জীবনের পথচলাকে উজ্জ্বল করলেও, ছোটবেলাতেই বাবার মৃত্যু তাকে অনাথ করে দেয়। সেই অনাথ শিশুটি শৈশবেই পবিত্র কুরআনের আলোয় জীবন ভরিয়ে তোলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি পুরো কুরআন মুখস্থ করেন। কিন্তু ভাগ্য যেন পরীক্ষা নিতে চাইল বারবার। ১৬ বছর বয়সে তার চোখে ভয়ানক সংক্রমণ দেখা দেয়, আর ২০ বছর বয়সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান তিনি।
মানুষ ভাবে, অন্ধকার মানেই পথচলার শেষ। কিন্তু শায়খ আবদুল আজিজ প্রমাণ করেছিলেন, দৃষ্টিশক্তি হারালেও অন্তরের দৃষ্টি যদি খোলা থাকে, তবে জ্ঞান অর্জনের পথে কিছুই বাধা হতে পারে না। তিনি সে সময়ের বিখ্যাত আলেম ও তৎকালীন গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম আলে শায়খসহ বহু গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যান। তার অধ্যবসায় ও প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে ১৯৬৪ সালে রিয়াদের শরিয়া কলেজ থেকে শরিয়া বিজ্ঞান ও আরবি ভাষায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর শুরু হয় তার শিক্ষকতা। ১৯৬৫ সালে তিনি রিয়াদের ইমাম দাওয়া বৈজ্ঞানিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। পরে দীর্ঘ সময় ইমাম মুহাম্মদ বিন সৌদ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। শিক্ষকতায় ছিলেন কঠোর, কিন্তু ন্যায়ের মূর্তপ্রতীক। তার ছাত্ররা বলতেন, তিনি জ্ঞান বিতরণ করতেন যেন নিজের অন্তরের আলো বিলিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু তার প্রকৃত উত্থান ঘটে মসজিদের মিম্বরে। ১৯৮২ সালে রিয়াদের ইমাম তুর্কি বিন আবদুল্লাহ মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন তিনি। এখান থেকেই শুরু হয় তার জনসমক্ষে দাওয়াতের নতুন অধ্যায়। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আসে যখন তাকে আরাফাতের দিনের খুতবা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। লাখ লাখ হাজি যখন ময়দানে সমবেত হতেন, তখন তার কণ্ঠের মাধ্যমে বয়ে যেত ইসলামের দিকনির্দেশনা। ১৯৮১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা ৩৫ বছর তিনি আরাফাতের ময়দানে খুতবা দিয়েছেন যা ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড।
১৯৮৭ সালে তিনি সৌদি আরবের সিনিয়র স্কলারস কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত হন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে আসেন সর্বোচ্চ আসনে। ১৯৯৫ সালে গ্র্যান্ড মুফতির ডেপুটি এবং ১৯৯৯ সালের জুনে বাদশাহ ফাহাদের আদেশে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি হিসাবে নিয়োগ পান। এ দায়িত্বই তাকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
তার ফতোয়া, বক্তব্য ও অবস্থান মুসলিম উম্মাহকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ২০১৩ সালে তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলাকে বড় অপরাধ ঘোষণা করেন। ২০১৪ সালে আইএস ও আল-কায়েদাকে ইসলামের এক নম্বর শত্রু বলে আখ্যা দেন। একই বছরে তিনি টুইটারকে ‘সব মিথ্যা ও পাপের উৎস’ আখ্যা দেন। মিনার ভয়াবহ হজ দুর্ঘটনার পর তিনি বলেন, মৃত্যু মানুষের নিয়ন্ত্রণে নয়, যা অনেকের কাছে রাজপরিবারকে দায়মুক্ত করার প্রচেষ্টা মনে হয়েছিল।
২০১৬ সালে তিনি দাবা খেলাকে হারাম ঘোষণা করে বলেন, এটি সময় অপচয় ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। একই বছরে ইরানিদের নিয়ে তার মন্তব্য ‘তারা মুসলমান নয়, বরং জাদুকরদের সন্তান’ তার এ ফতোয়া তীব্র বিতর্ক তোলে। কিন্তু অন্যদিকে তিনি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন কঠোর। মৃত্যুদণ্ডকে তিনি প্রতিশোধ নয়, বরং আল্লাহর রহমত হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।
সময় যত এগিয়েছে, তিনি নানা বিষয়ে অবস্থান নিয়েছেন। সিনেমা ও কনসার্টকে তিনি মানুষের মন কলুষিতকারী বলেছেন। সুইডেনে কুরআন অবমাননার ঘটনায় দেড়শ কোটি মুসলমানকে উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ২০২৫ সালে তিনি খুতবা ভিডিও করা বা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা রিয়ার (লোক দেখানো ইবাদত) অন্তর্ভুক্ত বলে ফতোয়া দেন। একই বছরের জুনে হজের অনুমতি ছাড়া পবিত্র স্থানগুলোতে প্রবেশকে শরিয়াবিরোধী ঘোষণা করেন।
করোনা মহামারির সময়ও তিনি সামনে আসেন। ফতোয়া দেন, তারাবি ও ঈদের নামাজ ঘরে আদায় করা যাবে, টিকা নেওয়া রোজার ক্ষতি করে না, আর স্বাস্থ্যবিধি মানা শরিয়ার দায়িত্ব। এভাবে সংকটময় সময়ে তিনি মুসলিম সমাজকে পথ দেখিয়েছেন।
শায়খ আবদুল আজিজ শুধু ফকিহ ছিলেন না, ছিলেন সৌদি রাজনীতিরও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে গৃহীত হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতি। তার ব্যক্তিত্ব এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিমদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করত।
দৃষ্টিহীনতা তাকে দমাতে পারেনি। বরং অন্ধকারে থেকেও তিনি জ্ঞান ও ইমানের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। তার চার সন্তান, অগণিত ছাত্র এবং কোটি কোটি মুসলমানের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার নাম।
তার জীবনের পরিসমাপ্তির মাধ্যমে পৃথিবী হারায় এক মহৎ আলেমকে, মিম্বর হারায় তার গম্ভীর কণ্ঠকে, আরাফাতের ময়দান হারায় তার দীর্ঘদিনের খুতবাকে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া আলোকিত দিকনির্দেশনা থেকে যাবে ইতিহাসের পাতায়, মানুষের অন্তরে।
শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ ছিলেন দৃষ্টিহীন হয়েও দৃষ্টিশক্তিমান এক মানুষ। অন্ধকারে থেকেও তিনি আলো জ্বালিয়েছেন। তার মৃত্যুতে মুসলিম উম্মাহ হারাল এক আলোর ফেরিওয়ালাকে। তবে তার রেখে যাওয়া আলো চিরকাল ইতিহাসের পথ আলোকিত করে যাবে ইনশাআল্লাহ।