আবারও একদিনে ১০ জনের মৃত্যু দেখলো চুয়াডাঙ্গাবাসী

করোনায় বিপর্যস্ত চুয়াডাঙ্গায় রোগীর সাথে বাড়ছে মৃত্যুও : প্রিয়জন হারানোর শোকে স্তব্ধ স্বজনেরা

আফজালুল হক: চুয়াডাঙ্গায় আবারো একদিনে ১০ জনের মৃত্যু দেখলো চুয়াডাঙ্গাবাসী। গত ২৪ ঘন্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে একজনসহ উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ১০ জন। বুধবার দিবাগত ভোররাত থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তাদের মৃত্যু হয়। অপরদিকে বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গায় আরও ১১০ জন নতুন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী শানাক্ত হয়েছে। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গায় শনাক্তকৃত সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ছিলো ২ হাজার ১০৭ জন। এর মধ্যে নিজ বাড়িতে ছিলেন ১ হাজার ৯শ ৮০ জন ও হাসপাতালে ছিলেন ১শ ২৭ জন।
করোনাভাইরাসে চুয়াডাঙ্গায় একের পর এক প্রিয়মুখগুলো হারাচ্ছে স্বজনেরা। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দৃশ্য দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন পাশের শয্যায় চিকিৎসা নেয়া অপর রোগীরা। প্রিয়জন হারানোর কষ্টে ভেসে আসা কান্নার শব্দে প্রতিনিয়ত ভারি হয়ে উঠছে হাসপাতাল চত্বর। শোকে স্তব্দ তারা।
চুয়াডাঙ্গায় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তার সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুলচারা গ্রামের মৃত তসিম আলীর ছেলে শুকুর আলী। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালের রেডজোনে মারা যান। সূত্র বলেছেন, শুকুর আলী সর্দি কাশি জ¦রে আক্রান্ত হলে তার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। ৮ জুলাই তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মৃতদেহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার যারা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন দামুড়হুদা উপজেলার কুড়ুলগাছি গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের মেয়ে আশিরা খাতুন। সম্প্রতি সর্দি কাশি জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। তাকে গত ৯ জুলাই সকাল ১০ টা ২০ মিনিটের দিকে সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। হলুদ জোনে ভর্তি করে নমুনা নেয়া হয়। পরীক্ষা করে গত বুধবার দিবাগত ভোর সোয়া তিনটার দিকে হাসপাতালের হলুদ জোনে মারা যান।
চুয়াডাঙ্গা গুলশানপাড়ার মহর আলী ম-লের মেয়ে দাসি ম-ল সম্প্রতি সর্দি কাশি জ্বরে আক্রান্ত হন। তাকে গত ৯ জুলাই সকাল পৌনে সাতটার দিকে দিকে সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। হলুদ জোনে ভর্তি করে নমুনা নেয়া হয়। পরীক্ষা করে তার নেগেটিভ আসে। গত বুধবার দিবাগত ভোর চারটার দিকে হাসপাতালের হলুদ জোনে মারা যান তিনি। দামুড়হুদা উপজেলার মৃত নূর বক্সের মেয়ে সকিনা খাতুন সম্প্রতি সর্দি কাশি জ্বরে আক্রান্ত হন। তাকে গতকাল সকাল ১০ টা ৫০ মিনিটের দিকে সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। হলুদ জোনে ভর্তি করে নমুনা নেয়া হয়। ১০ মিনিট পরই হাসপাতালের হলুদ জোনে মারা যান তিনি। ৮০ বছরের মফিদা খাতুন সম্প্রতি সর্দি কাশি জ্বরে আক্রান্ত হন। তাকে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে হাসপাতালে নেয়া হলে জরুরি বিভাগের মধ্যেই তার মৃত্যু নয়। তিনি আলমডাঙ্গা উপজেলার কুলপালা গ্রামের মফিদুল ইসলামের স্ত্রী। পরে স্বাস্থ্য বিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট ল্যাবে পাঠায়। সম্প্রতি সর্দি কাশি জ্বরে আক্রান্ত হন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ জোনাব আলী। গতকাল বিকেলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের হলুদ জোনে ভর্তি করা হলে তার পাচ মিনিট পরই তিনি মারা যান। স্বাস্থ্যবিভাগ তার নমুনা সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট ল্যাবে পাঠায়।
আলমডাঙ্গা অফিস জানিয়েছে, করোনা উপসর্গ নিয়ে গত ২৪ ঘন্টায় আলমডাঙ্গা উপজেলায় আরও ৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পারকুলা গ্রামের মৃত মানিক জোয়ার্দ্দারের ছেলে ফিকির চাঁদ জোয়ার্দ্দার (৬০) গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন। তিনি সম্প্রতি সর্দি জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে চিকিৎসার জন্য আলমডাঙ্গা শহরে নিয়ে যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়েছে। একই দিন সকালে কালিদাসপুর গ্রামের মৃত রমজান আলীর ছেলে বাবলুর রহমান (৫৫) করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। তিনি প্রায় ১২-১৩ দিন আগে সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। গোবিন্দপুর মাঠপাড়ার ঘরজামাই আব্দুস সাত্তার (৬০) গত বুধবার দিনগত গভীর রাতে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। তিনিও সম্প্রতি সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। একই রাতে উপজেলার অনুপনগরের ইদবার আলীর স্ত্রী আনারী খাতুন (৬৭) করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। বুধবার তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে স্যাম্পল দিয়ে বাড়ি যান। ওই রাতেই তিনি মারা গেছেন।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ গতকাল বৃহস্পতিবার ৪৩৮ জনের নমুনা সংগ্রহ করে। এদিন ৪৬৩ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১১০ জন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত তথা কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার শনাক্তকৃত ১১০ জনের মধ্যে সদর উপজেলার ৬০ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলার ২৫ জন, দামুড়হুদা উপজেলার ১৬ জন ও জীবননগদর উপজেলার ৯ জন।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গায় বৃহস্পতিবার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন একজন। এ নিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা ১৪৮ জন। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গাতেই মারা গেছেন ১৩২ জন। চুয়াডাঙ্গার বাইরে মারা গেছেন ১৬ জন। বৃহস্পতিবার নতুন ৪৩৮ জনের নমুনা নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে মোট নমুনা নেয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৯শ ৮১ জনের। বৃহস্পতিবার ৪৬৩ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মোট রিপোর্ট পাওয়া গেছে ১৮ হাজার ৬শ ৫৩ জনের। নতুন ১১০ জন শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে জেলায় মোট শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৬৫ জন।
এদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার থেকে বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রেডজোন এবং হলুদ জোনে ধারণক্ষমতা ১৫০ জনের। সেখানে ১৮৯ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ৯৩ জন রেডজোনে ও হলুদ জোনে রয়েছেন ৯৬ জন। যেখানে ২৪ জন চিকিৎসক এবং নার্স দরকার ৭২ জন। সেখানে আছেন ১০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৫ জন কোয়ারেন্টিনে থাকেন, বাকি ৫ জন ডিউটি করেন। ৩৫ জন নার্সের মধ্যে ১৭ জন কোয়ারেন্টাইনে ও ১৭ জন ডিউটি করেন। একজন ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করে। সেবা দিতে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. এএসএম ফাতেহ আকরাম বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন ১৫শ থেকে ২ হাজার লিটার অক্সিজেন লাগছে। তবে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই।

Comments (0)
Add Comment