মাথাভাঙ্গা মনিটর: সন্ধ্য নামছে। রাত বাড়ছে। ঢুলুঢুলু চোখেই পার হয়ে যাচ্ছে মধ্যরাতও। তবু ঘুম নেই! উলটো আতঙ্ক। বদ্ধঘরে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। ছাদ-মেঝে, দেওয়াল বা ব্যালকনিতে একটু ছন্দপতনেই আঁতকে উঠছে সবাই। চঞ্চল হয়ে উঠছে ভয়ে বিবর্ণ পরিবার-এই বুঝি উড়ে এলো ক্ষেপণাস্ত্র দানব! সাঙ্গ হলো ভবলীলা! গত ৩ দিন ধরে এই আতঙ্কেই ঘুম উড়ছে ইরান-ইসরাইলের জনপদে। শনিবার রাতটা ছিলই সবচেয়ে বিভীষিকাময়। মৃত্যু ভয়ে ঘুম উড়ে গিয়েছিলো দুদেশের চোখেই। রাজধানী ও সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে। রাতভর দুই বাহিনীর হামলা-পালটা হামলার দাপটে অবস্থা এমন হয়ে উঠেছিলো যেন পলক ফেললেই আগুনের কু-লী হয়ে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে আসবে প্রাণঘাতী ক্ষেপণাস্ত্র। কিংবা খানিক অসাবধানেই পাশের দুমড়ে-মুচড়ে ধসে পড়া ভবনটি গায়ে এসে পড়বে। মধ্যরাত রাতের বিশ্রাম; নিশ্চিন্ত নিদ্রা-দিনশেষের এ চিত্র এখন ইরান-ইসরাইলে পুরোটাই উলটো। রাত বাড়লেই মৃত্যু নামছে সেখানে। শোকের মাতম উঠছে দুদেশেই। শনিবার রাতভর পালটাপালটি হামলা চালিয়েছে ইরান-ইসরাইল। একটার পর একটা। এক শহর থেকে অন্য শহর। ৫০টি যুদ্ধবিমানে ইরানে ৮০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পালাক্রমে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তছনছ করে দিয়েছে তেহরানসহ বেশ কয়েকটি এলাকা। অপরদিকে রাতভর শত শত মিসাইল ছুড়ে ইসরাইলের দুই শহর হাইফা ও বাত ইয়াম লন্ডভন্ড করে দিয়েছে ইরান। সাইরেন-ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে থেমে থেমেই আঁতকে উঠেছে দুই শহর। তেল আবিবের উপকূলীয় শহর বাত ইয়ামে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইরান। ধুলোয় মিশে গেছে ছোট-বড় প্রায় ডজনখানেক ভবন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক ডজন ভবন। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, গাজার মতো কঙ্কালসার শরীর নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বাত ইয়ামের আধুনিক নগর সভ্যতার বিরাট একটি অংশ। শনিবার রাতভর শহরটিতে প্রায় ১০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। গতকাল রোববার বাত ইয়ামের মেয়র তজভিকা ব্রট শভা ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘ব্যাপক ধ্বংস এবং ডজন ডজন ভবনের ক্ষতি হয়েছে। মৃত্যুর পাশাপাশি ১০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। অন্যরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন।’ এদিকে হাইফা শহরেও ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, ইরানি বাহিনী রাতারাতি ইসরাইলে প্রায় ৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। যার মধ্যে ৪০টি উত্তরাঞ্চল হাইফায় আঘাত হেনেছে। এতে অনেক ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশকিছু ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। এছাড়া ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হাইফার তেল শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম। বিশেষ করে পাইপলাইন এবং ট্রান্সমিশন লাইনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া ইরানের হামলায় ইসরাইলের কেন্দ্রীয় শহর রেহোভে গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি স্থাপনা নষ্ট হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। তবে এই হামলায় কেউ হতাহত হয়নি বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট। এদিকে থেমে নেই ইসরাইলি হামলাও। ইরানের ইসফাহান শহরে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি স্থাপনায় ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে তেহরান। ইরানি বার্তা সংস্থা আইএসএনএকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন ইসফাহান প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর আকবর সালেহি। তবে হামলার পরও ইসফাহানের তেল শোধনাগার সম্পূর্ণ সক্রিয় আছে বলে জানিয়েছে ইরানের তেল মন্ত্রণালয়। ইরান-ইসরাইলের পালটাপালটি এ হামলায় ইরানে ১২৮ জন নিহত ও ৯০০ জন আহত হয়েছেন। তবে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে-ইরানে ৪০৬ জন নিহত এবং ৬৫৪ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইলে ১৩ জন নিহত ও ৩০০র বেশি আহত হয়েছেন। এরই মধ্যে তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে ইরানও হামলা থামাবে। ইসরাইলকে উদ্দেশ করে আরাগচি আরও বলেছেন, ‘হামলা বন্ধ হলে, আমরাও থেমে যাব।’ ইরান-ইসরাইলের উত্তেজনার মধ্যেই ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে হুথিরাও।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এক্সিওসের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসরাইল ইরানের ‘ফোর্ডো’ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাটি ধ্বংস করার সক্ষমতা রাখে না। কারণ, এটি পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত। তাই তারা এই স্থাপনাটিকে কার্যকরভাবে লক্ষ্যবস্তু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায়। এদিকে ইরান ও ইসরাইলের চলমান সংঘাত নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলায় জড়িত নয় এবং এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে সহজেই চুক্তি সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প বলেছেন, আমরা চাইলে খুব সহজেই ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন করতে পারি এবং এই রক্তাক্ত সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারি। তবে ইরানে হামলা নিয়ে ট্রাম্প শিবিরে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।