বিএনপি-এনসিপি মুখোমুখি : উত্তাপ বাড়ছে রাজনীতিতে

স্টাফ রিপোর্টার: শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের দাবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একযোগে মাঠে থাকা বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে কথার লড়াই চলছে। একে অন্যকে অনেকটা আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলায় দু দলের সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ততার দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা না করার ইস্যুকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। আইনি জটিলতার কথা বলে ইশরাকের শপথ নেয়ার সুযোগ নেই- সাফ জানিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। অন্যদিকে শপথ নিতে অনড় ইশরাক হোসেনের জন্য প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিচ্ছে বিএনপি। দাবি উঠছে উপদেষ্টা আসিফের পদত্যাগের। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাজনীতির মাঠে অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা সাধারণ মানুষের। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি ও তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা অন্তবর্তীকালীন সরকারকে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। সে অনুযায়ী শুরুর দিকে একাধিক প্লাটফর্মে একই সুরে কথাও বিএনপি ও ছাত্র নেতারা। তবে নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপি সরব হওয়ার পর থেকে দূরত্ব বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন হলে বিএনপির নির্বাচনের দাবির কড়া বিরোধিতা শুরু করেন নেতারা। বিএনপি যখন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলছে তখন এনসিপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচনের বিরোধিতা করছে। ক্রমেই দুই দলের নেতারা নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সবশেষ ইশরাকের শপথ গ্রহণের ইস্যুতে কেন্দ্র করে প্রকট আকার ধারণ করছে। ইশরাকের অনুসারীদের টানা বিক্ষোভের মাঝে তার মেয়র হিসেবে শপথের বিষয়ে ১০ ধরনের বাধার কথা তুলে ধরেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সোমবার উপদেষ্টা আইনি জটিলতার কথা তুলে ধরার পর তার পাল্টা জবাব দেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। শুধু তাই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের তীব্র সমালোচনা করে শপথ নেওয়ার বিষয়ে নিজের অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। শুধু ইশরাকই নন, বিএনপির শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরাও উপদেষ্টা আসিফ এবং এনসিপি নেতাদের জড়িয়ে কথা বলেন। পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ভূমিকার কথা তুলে ধরে এনসিপির শীর্ষ নেতা আব্দুল হান্নান, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমরা ফেসবুকে পোস্ট করেন। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা এসব ছাত্রদের ভূমিকার কথা বলে আইন উপদেষ্টাও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলছে তখন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপি ভিন্ন সুরে কথা বলছে। নতুন এই রাজনৈতিক দল দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণপরিষদ নির্বাচনেরও দাবি করছে। একই সঙ্গে গণপরিষদের মাধ্যমে ‘নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে স্থিতিশীল করার পরিবর্তে এসব দাবি তুলে মূলত এনসিপি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। এতে সরকারের মদদ আছে এমন অভিযোগও করা হচ্ছে। আর বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে এনসিপি নেতারা বলছেন, এক দলকে সরিয়ে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসানো গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ছিল না। একটি দলকে ক্ষমতায় বসাতে নির্বাচন চাপিয়ে দিলে মেনে নেয়া হবে না। সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে দুই দলের নেতারা এমন পাল্টাপাল্টি কথা বলেছেন। গত ২৬ মার্চ জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাভার স্মৃতিসৌধে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানানো শেষে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সংস্কার ও বিচার ছাড়াই নির্বাচনকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পুনর্বাসনের জন্য নানা ধরনের পাঁয়তারা চলছে।’ অন্যদিকে এনসিপির দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যখন শুনি আগে সংস্কার পরে নির্বাচন-এ যেন শেখ হাসিনার সেই কথারই প্রতিধ্বনি, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র।’ সবশেষ মঙ্গলবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেছেন, সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের সজাগ থেকে এসব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইশরাকের অনুসারীদের আন্দোলন নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সোমবার বলেন, গায়ের জোরে নগর ভবন বন্ধ করে বিএনপি আন্দোলন করছে। ইশরাকের শপথ নিয়ে জটিলতা নিরসন না করা পর্যন্ত শপথ গ্রহণ সম্ভব নয় বলেও সাফ জানিয়েছেন তিনি। আসিফের সুরে কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। ইশরাকের উদ্দেশে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যে নির্বাচন অবৈধ, সেই নির্বাচনের মেয়র আমি কীভাবে হতে চাই? সেটা কীভাবে বৈধ হয়? তাহলে তো সেই নির্বাচনকে আমি বৈধতা দিয়ে দিচ্ছি।’ এরপরই পাল্টে যায় চিত্র। সরকারে থাকা কতিপয় ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে ইশরাক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ‘মেয়র ফেওর কিছু না। অন্তর্বর্তী সরকারের কতিপয় ব্যক্তির অন্তরে ক্ষমতার লোভ ও এটি চিরস্থায়ী করার কুৎসিত সত্যটা বের করে আনাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। ‘সর্বশক্তি দিয়ে এরা ঢাকায় বিএনপির মেয়র আটকানোর চেষ্টার মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কী ভূমিকা পালন করবে, তা ক্লিনকাট বুঝিয়ে দিল।’ যারা নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে একটি দলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন, অবিলম্বে তাদের পদত্যাগ দাবি করেছেন তিনি। এই কথার রেশ না কাটতেই আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিএনপি চলে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, বিএনপি নেতারা যদি একত্রে প্রস্রাব করে দেন তাহলে এই প্রস্রাবের তোড়ে ভেসে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়বা। এমন কোনো কথা বলবা না যে কথার দায়িত্ব নিতে পারবা না। এর জবাব দিতে গিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে সারজিস আলম লিখেছেন, ‘এত কিছু না করে বিগত ১৬ বছরে দুদু ভাই একটা গণপ্রস্রাব কর্মসূচির ডাক দিলেই পারতেন!’ একইদিন ঢাকায় দিনভর বৃষ্টি হওয়ায় সারজিস ফের পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, ‘ঢাকায় মুষলধারে যেটা হচ্ছে সেটা বৃষ্টি নাকি দুদু ভাইয়ের দেয়া কর্মসূচি?’ এর আগে কুমিল্লায় দেয়া হাসনাতের প্রত্যাহার করতে স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে সাত দিনের আলটিমেটাম দেয়া হয়। এদিকে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা প্রকাশ করে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি ফেসবুকে লিখেছেন, ইশরাক ভার্সেস আসিফ। বিএনপি ভার্সেস এনসিপি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।যারা জিতবেন তারাই আগামীতে টিকবেন। যারা হারবেন তাদেরকে ভোগ করতে হবে ঐতিহাসিক দুর্ভোগ, দুর্দশা, অপমান আর গ্লানি।