ভোটের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়াচ্ছে পিআর

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি ভিন্নমত জামায়াতে ইসলামীসহ একাধিক ইসলামি দলের। তারা পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করছেন। জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) পিআর পদ্ধতির পক্ষে। এতদিন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে পিআরের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বললেও সম্প্রতি মাঠে-ময়দানেও বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন রাজনীতিকরা। শুধু তাই নয়, পিআরের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় বিএনপিকে সমাবেশে আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানায়নি দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াত। এর আগে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও বিএনপিসহ তার সমমনা দলগুলোকে সমাবেশে আমন্ত্রণ জানায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পিআর পদ্ধতির আলোচনার ঝড় না থামলে রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বাড়বে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে গড়ে ওঠা জুলাই ঐক্যেও ফাটল ধরাতে পারে এই আলোচনা। রাজনীতিবিদরা সহনশীল না হলে এর প্রভাব নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সহযোগী অধ্যাপক মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ঐক্য দরকার। ঐকমত্য কমিশনে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে এসে ঐক্য বিনষ্ট করার পরিবেশ তৈরি করা উচিত নয়।’ এই বিশ্লেষক বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোনো দেশেই জনপ্রিয় নয়। বাংলাদেশে কনস্টিটিউন্সি বা নির্বাচনী এলাকা, এর সাথে সম্পর্কিত একজন এমপির কার্যক্রম এবং জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনে যেভাবে গড়ে উঠেছে পিআর পদ্ধতি তা সম্পূর্ণ ডেস্ট্রয় (ধ্বংস) করে দেবে। ফলে আপাতত সেদিকে না যাওয়াই ভালো হবে। তবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হলে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। ৫ আগস্টের পরে অনেক ভুল হয়েছে। আর ভুল করা ঠিক হবে না। এখন জাতীয় ঐক্যকেই গুরুত্ব দিতে হবে।’
গত ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে নিজেদের প্রস্তাব উপস্থাপন করছে। নিবন্ধন স্থগিত ও বাতিল হওয়া দলগুলোর বাইরে নিবন্ধিত ৫০টি দলের মধ্যে ১৮টি দল পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ২৮টি দল। আর চারটি দল তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি।
এরমধ্যে কয়েকটি দল আংশিকভাবে পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। কেউ আবার নি¤œকক্ষ পিআর পদ্ধতিতে চান। নিম্ন নয়, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেও প্রস্তাব এসেছে কমিশনের বৈঠকে।
প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিএনপি ও তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা পিআরের বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। আর এনসিপি ছাড়া জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামিক দল পক্ষে, কেউ আবার পিআরের বিপক্ষে প্রস্তাব দিয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের সুপারিশ করেছে। যদিও এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা সুপারিশ কমিশনের পক্ষ থেকে করা হয়নি।
রোববার (২০ জুলাই) দুপুরে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘উচ্চকক্ষ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে দ্রুত মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
এদিকে শুরু থেকেই পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়া বিএনপি নেতারা এই আলোচনাকে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতিতে নির্বাচন কেন বাংলাদেশের বাস্তবতায় সম্ভব না তাও তুলে ধরছেন নেতারা।
বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ পিআর পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেছেন, ‘পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ভোট দেবেন একজনকে, কিন্তু এমপি পাবেন আরেকজনকে।’ আর বিএনপির কেন্দ্রীয় ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হকের ভাষ্য, ‘যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়, তাদের মেম্বার হওয়ারও যোগ্যতা নেই। তারা জানে জনগণের ভোটে জিততে পারবে না, তাই বিকল্প পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে।’
নির্বাচন পেছানোর শঙ্কা প্রকাশ করলেও বিএনপি নেতারা আশা করছেন সরকারঘোষিত ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। রোববার (২০ জুলাই) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আশা করি, আগামী দিনে যে নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন এই অন্তর্বতীকালীন সরকার যে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘দেশের মানুষ এক ধরনের নির্বাচন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত। সেখানে হঠাৎ করে নতুন একটি পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব এলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য করা। আমরা জনগণের দল হিসেবে দেশের বাস্তবতার কথা চিন্তা করে প্রস্তাব করেছি। অন্যরা তাদের মতো প্রস্তাব করেছে। তবে আশা করি পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হতে হতে আলোচনার টেবিলে সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।’
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয় নিয়ে রাজনীতিবিদরা এখন আর বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই ইস্যু এখন গড়িয়েছে সরাসরি রাজনীতির মাঠে। গত ২৮ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ বেশ কিছু দাবিতে সমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। যেখানে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের ওই সমাবেশে যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিপক্ষের কোনো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।’
অন্যদিকে পিআর পদ্ধতিতে ভোটসহ সাত দফা দাবিতে একই ভ্যানুতে গত ১৯ জুলাই ডাকা সমাবেশে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপিসহ অন্যান্য দলকে আমন্ত্রণ জানায়নি জামায়াত। অবশ্য পিআর পদ্ধতির পক্ষে থাকলেও জামায়াতের আমন্ত্রণ পায়নি আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টি। যেহেতু জামায়াত থেকে চলে আসা নেতারা দলটি করেছেন এজন্য তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানা গেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ঘিরে দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য গড়ে উঠলেও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিভেদ দেখা দিয়েছে। এই ইস্যুতে কেন্দ্র করে দিনে দিনে জুলাই ঐক্যে ফাটল বাড়তে পারে- এমন আশঙ্কা থাকলেও রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ আশা ছাড়তে রাজি নন।
সংস্কার আটকে যাওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করে জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে স্বচ্ছ নির্বাচনের বিরোধিতা করা মানে তারা জাতির প্রত্যাশা নিয়ে সচেতন নয়।’ আর দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ পিআরের দাবি না মানলে রাজপথে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এদিকে বিএনপির সমমনা রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম পিআর নিয়ে আলোচনার জন্য জামায়াতকে দায় দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরও কিন্তু পিআর নিয়ে কোনো আলোচনা ছিল না। ঐকমত্য কমিশনও নিম্নকক্ষে পিআর চালুর কথা বলছে না। হঠাৎ করে জামায়াত, চরমোনাই পীরের দলসহ কেউ কেউ এ নিয়ে কথা বলছেন। অথচ পুরো পদ্ধতি কীভাবে হবে তাও এরা বলতে পারেনি।’