সড়কে নৈরাজ্যকে শিক্ষার্থীদের ‘লাল কার্ড’

আজ ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন প্রতীকী লাশের মিছিল

স্টাফ রিপোর্টার: লালকার্ড নিয়ে মাঠে নেমেছেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ফুটবল খেলায় বিশৃঙ্খলার দ- হিসাবে রেফারি যেমন লাল কার্ড দেখান, সড়কে নৈরাজ্যের প্রতিবাদে তেমনই কার্ড প্রদর্শন করলেন তারা। রাজধানীর রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে শনিবার দুপুরে এ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সড়ক নিরাপত্তায় আশ্বাস না দিয়ে দ্রুততম সময়ে দাবি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তারা। সড়কে অরাজকতার প্রতিবাদ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে আজ ‘ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়ে শেষ হয় শিক্ষার্থীদের অবস্থান। এদিকে শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ আজ রাজধানীর শাহবাগে প্রতীকী লাশ নিয়ে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী দুপুর সোয়া ১২টায় রামপুরা সেতুতে আসেন ১১ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। রামপুরা, বনশ্রী ও খিলগাঁও এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। তারা বিভিন্ন প্রতিবাদী পোস্টার প্রদর্শন করেন। যাতে লেখা ছিল-‘সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হবে’, ‘ড্রাইভারদের ৬ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা কার্যকর করতে হবে’, ‘মাইনুদ্দীন ও নাইমের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে’, ‘সারা দেশে হাফ পাশ কার্যকর করতে হবে’।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থী খিলগাঁও মডেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, দরিদ্র গাড়িচালকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে রাষ্ট্র, পরিবহণ মালিক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ। সড়কের উন্নয়ন কাজের জন্য যে বরাদ্দ হয় তার অর্ধেক দুর্নীতির কারণে গায়েব হয়ে যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাস্তা করা হয়, কিন্তু বছর না যেতেই তা বেহাল হয়ে যায়। এমন অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া তৈরি হয়েছে। খেলায় অনিয়ম করলে রেফারি যেভাবে লাল কার্ড দেখান, আমরাও রেফারির ভূমিকা পালন করে সড়কের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখাচ্ছি।
এ ছাত্রী আরও বলেন, গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় রামপুরা সেতুর ওপর মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। কর্মসূচি থেকে সড়ক অব্যবস্থাপনায় জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরাসরি অরাজকতার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা হবে। চলমান এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার কথা বিবেচনা করে আমাদের এ কর্মসূচি। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশের আহ্বান জানাচ্ছি।
এদিকে আন্দোলনকারী সোহাগী সামিয়াকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম তথ্য এসেছে। তিনি ছাত্রী নন এবং রাজনৈতিক দলের কর্মী বলে প্রচার চালানো হয় সেখানে। শনিবারের কর্মসূচিতে এ নিয়ে কথা বলেন সোহাগী। তিনি বলেন, ‘আমি নাকি ছাত্রী না, আমি নাকি ৩০ বছরের নারী। আমি নাকি স্কুল ড্রেস পরে শিক্ষার্থীদের উসকানি দিচ্ছি। প্রথমে বলতে চাই, আমাদের ছাত্ররা রোবট না। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে। দ্বিতীয়ত, আমি ৩০ বছরের নারী নই। আমার কাছে আইডি কার্ড আছে। আমি যে একজন ছাত্রী তার সব প্রমাণ আমি এখানে হাজির করেছি।’
নিজের রাজনৈতিক অবস্থানও পরিষ্কার করেন সোহাগী। তিনি বলেন, ‘আমি বুক ফুলিয়ে বলছি, আমি ২০১৭ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট করি। আমি ঢাকা মহানগরের দপ্তর সম্পাদক। প্রশ্ন এখানে না, আমি এ দেশের একজন নাগরিক। আমার সংগঠন করার অধিকার রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এটা যে, আমি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু এখানে টেনে এনেছি কিনা। আমি শুরু থেকেই এ আন্দোলনে যুক্ত। আমার কোনো সেøাগান, আমার কোনো বক্তব্যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু আনিনি, সেটা সবাই জানে।’ এ সময় সোহাগী নিজের পরিচয়পত্র তুলে ধরে বলেন, ‘আমি আমার আইডি কার্ড আপনাদের সামনে শো করছি। আমি খিলগাঁও মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পরিক্ষার্থী।’
সড়কে অবস্থান নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এরমধ্যে ছিল-‘সড়ক সড়ক সড়ক চাই, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘ছাত্র মারার আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘দুর্নীতির আস্তানা, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’। দুপুর সোয়া ১টায় শেষ হয় অবস্থান কর্মসূচি।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন-২০২১’ ব্যানারে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ রামপুরা সেতুতে মানববন্ধন করেন। ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি), কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। কর্মসূচি চলে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত। এ মানববন্ধনে তারা ঘোষণা দেন, নয় দফা দাবিতে কাল (আজ) শাহবাগ থেকে প্রতীকী লাশ নিয়ে মিছিল করবেন।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, সড়কে প্রশাসনকে ঘুষ দিয়ে চালকের লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও তারা বেপরোয়া ভাব অব্যাহত রেখেছে। ২০১৮ সাল থেকে আমরা শুধু সড়ক নিরাপদ করার আশ্বাস পেয়েছি, এখন এর বাস্তবায়ন চাই। দাবির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। আমরা আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা চাই না।
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইনজামুল হক বলেন, দাবির বাস্তবায়নে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসাবেই আমরা প্রতীকী লাশ নিয়ে মিছিল করব। শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি সড়কে যদি কোনো শিক্ষার্থী বাসচালক ও সহযোগীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন, তাহলে তাদের ছবি তুলে রাখতে হবে। যাতে পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ৭ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে বাসের ভাড়া ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ নভেম্বর অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরমধ্যেই ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন। ২৯ নভেম্বর রামপুরায় মাঈনুদ্দিন নামের এক শিক্ষার্থী অনাবিল পরিবহণ বাসের চাপায় নিহত হন। তারপর থেকে নিরাপদ সড়ক, অর্ধেক ভাড়াসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ নভেম্বর রাজধানীতে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয় পরিবহণ মালিক সমিতি।

Comments (0)
Add Comment