গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে পাঁচটি সমন্বয় ও তদারকি কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন। এটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি। নির্বাচন সুষ্ঠু করার উদ্দেশ্যে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পদায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে আট লাখের মতো সদস্য মাঠে থাকবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। এ ছাড়া পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডে যে নতুন করে ১৭ হাজার সদস্যকে নিয়োগ করার কথা আছে, তাদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ওপর নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। বৈঠকে নির্বাচনের আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) রদবদল করার বিষয়ে আলোচনা হলেও কীভাবে সেটা হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। বদলি প্রক্রিয়ায় যাতে কেউ প্রভাব খাটাতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গত তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে যেসব প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে পারলে ভালো। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা পাওয়া যাবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়েও মনিটরিং সেল গঠন করা হবে, যাতে অনিয়ম হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারলে নির্বাচনের অনিয়ম ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। আগে নির্বাচনের সময় চার দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হতো। এবার সাত দিনের কথা ভাবা হচ্ছে। এটাও ভালো সিদ্ধান্ত বলতে হবে। ওই বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রশাসনিক দিক নিয়েই এই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সব অংশীজনকেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। ভোটার, ভোটপ্রার্থী, সরকার ও নির্বাচন কমিশন, যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা অসম্ভব নয়। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষা করার দায়িত্ব মূলত সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সহযোগিতা ছাড়া সেটা সম্ভব হবে না। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সবার কাম্য। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। ধর্ম-বর্ণ ও জাতি-নির্বিশেষে যাতে প্রত্যেক নাগরিক নির্বিঘেœ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারেন, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সরকারপ্রধান যখন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করতে বলেছেন, তখন নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে ফেব্রুয়ারি না এপ্রিল ধোঁয়াশা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে জানানো হয়েছিলো। মাঠে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আওয়ামী লীগ আমলের তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) জনগণ ভোট দিতে পারেননি। বিশেষ করে এই সময়ে যারা প্রথম ভোটার হয়েছেন, তারা ভোট দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনের সব প্রস্তুতি যথাযথভাবে সম্পন্ন হোক এবং দেশ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।