সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ কার্যকর হওয়ার পর থেকেই এটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আন্দোলনকারীরা অধ্যাদেশটি প্রত্যাহারের দাবিতে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে সরকারি অফিসে কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটেছে। জনগণকে জিম্মি করে বা কাজ বন্ধ করে কর্মসূচি পালন করার বিষয়টি নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। অধ্যাদেশটিতে চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতায় এনে তিনটি শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
এগুলো হলো বরখাস্ত, অব্যাহতি এবং বেতন ও পদের গ্রেড কমিয়ে দেয়া। যেসব অপরাধের জন্য শাস্তি দেয়া যাবে সেগুলো হলো-অনানুগত্য দেখানো ও কাজে বাধা দেয়া, একক বা সমবেতভাবে কাজে অনুপস্থিত থাকা, কাউকে কাজ থেকে বিরত থাকতে উসকানি দেয়া এবং কাউকে কাজ করতে বাধা দেয়া। সরকারি কর্মচারীদের আশঙ্কা, এ অধ্যাদেশের কারণে সরকারি কর্মচারীদের যে কোনো নিবর্তনমূলক সিদ্ধান্তও বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে এবং তাদের মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণœ হতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই মনে করেন, এটি প্রয়োগ করে যে কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ঘটনা ঘটতে পারে। এর মাধ্যমে ভিন্নমতে বিশ্বাসীদের জন্য চাকরি করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর বিভিন্ন ধারায় ইতোমধ্যে বেশকিছু দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর অপপ্রয়োগের শঙ্কা রয়েছে। অপরাধ না করেও অনেকে সাজার মুখোমুখি হতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আক্রোশের শিকার হতে পারেন বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও অধ্যাদেশটির কিছু ধারার অপব্যবহারের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত ৪ জুন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে-অধ্যাদেশে কর্মচারীর অপরাধ তদন্তের সুযোগ রাখা হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া জরুরি। তদন্তের মাধ্যমে দোষী-নির্দোষ প্রমাণিত হবে। তদন্ত ছাড়া একজন কর্মচারী দোষী না নির্দোষ, তা কীভাবে প্রমাণ হবে? এ ধরনের ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা অনেক বেশি। কর্তৃপক্ষের অন্যায় ও খামখেয়ালিপনার শিকার হতে পারেন কর্মচারীরা। কর্মকর্তারা নিজের ইচ্ছামতো যখন-তখন যে কাউকে চাকরিচ্যুত করতে পারবেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নিবর্তনমূলক এ অধ্যাদেশটি নারী কর্মীদের জন্য আরও ভয়ংকর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনো অসাধু কর্মকর্তা তার অধীনস্থ নারী কর্মচারীকে নানাভাবে নাজেহাল করতে পারেন।
আলোচ্য অধ্যাদেশে অনানুগত্যের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। কোনো দুর্নীতিবাজ অফিসপ্রধানের কথা যদি নীতিমান কোনো কর্মচারী না শোনেন, তখন সেই কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনানুগত্যের অভিযোগ এনে তাকে চাকরিচ্যুত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বস্তুত আনুগত্য প্রমাণে কর্মচারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবেন। কারণ, খারাপ কর্মকর্তারা কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেবেন। এতে অধ্যাদেশটির অপব্যবহারের সুযোগ থেকেই যায়। আলোচ্য অধ্যাদেশে যেসব দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো সময়োপযোগী করতে হবে। তা না হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাদারি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।