পলাশী থেকে বাংলাদেশ : একটি জাতির শৃঙ্খলিত আত্মার দলিল রহমান মুকুল

পলাশীর প্রান্তরে কেবল একটি যুদ্ধ হয়নি, এক মহাজাতির হৃদপি-ে বিষবৃক্ষের চারা রোপণ হয়েছিল সেদিন। ১৭৫৭ সালে যখন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতন হলো, তখন থেকে শুরু হলো আমাদের আত্মার এক দীর্ঘ শৃঙ্খলযাত্রা। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা কেবল সিরাজকে হারায়নি হারিয়েছে আমাদের শ্রদ্ধা, সাহস ও শেকড়। পলাশীর পর থেকে এই বাংলার মাটি পর হয়ে গেল বাংলার সন্তানদের কাছে। আমরা যেন পরাধীনতার নতুন নতুন পোশাক পরে যুগের পর যুগ বেঁচে থেকেছি-কখনো ব্রিটিশ বেনিয়াদের ছায়ায়, কখনো পাকিস্তানি জান্তার হিংস্র থাবায় আবার কখনও ব্র্যাক্ষ্মণ্যবাদী চাণক্য থাবায়।
জিম করবেট তার: ‘ইন্ডিয়ান মুসলিম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা যখন ভারতবর্ষে আসি, তখন মুসলমানদের অবস্থা এত ভালো ছিল যে কেউ কল্পনাও করতে সাহস পেতো না যে মুসলমানরা কোনদিন দরিদ্র হবে। অথচ, এখন ব্রিটিশ ভারতের এই সময় কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে, মুসলমানরা আবার কখন সচ্ছল হবে।’
আত্মঘাতী বাঙ্গালী: লর্ড ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘নবাবকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অপমান করতে করতে, তখন দাঁড়িয়ে থেকে যারা এসব প্রত্যক্ষ করেছিল তারা যদি একটি করেও ঢিল ছুড়ত তবে আমাদের বাহিনি ঢেলার স্তুপে ঢাকা পড়ে যেত। নিশ্চিত পরাজয় বরণ করতে হতো।’ নেতা-নেতৃত্বের অবিমৃশ্যকারিতায়, জনতার অসচেতনতায় জাতীয় ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়েছে যুগে যুগে। পাকিস্তানের বঞ্চনা-বৈষম্য আর জলপাইভ্রঙের দু:সাসন মাড়িয়ে অবশেষে, বহুল আকাক্সিক্ষত ১৯৭১ পেলাম-যেখানে আমাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হলো একটি লাল-সবুজ স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ কি পূর্ণ হলো? সত্যিকারের স্বাধীনতা কি আমরা পেয়েছি? পেয়েছি কি অর্থনৈতিক মুক্তি?
ভারতীয় গোলামীর জিঞ্জির: স্বাধীনতার নামে এক নতুন শিকল পরানো হলো আমাদের! ভারতের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে সদ্যোজাত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো একটি নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশ-নামমাত্র স্বাধীন, অথচ নিয়ন্ত্রিত। ভারতের স্যাটেলাইট হয়ে ভাগ্যবরণের দুর্ভাগ্য। বাংলা ভাষায় কথা বলি, অথচ সিদ্ধান্ত হয় দিল্লির ছাদে! আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, এমনকি সীমান্তের নিরীহ জনপদগুলোও বারবার রক্তাক্ত হলো ভারতীয় আগ্রাসনে। এ জাতি জয় করলো মুক্তিযুদ্ধ, কিন্তু হার মানলো ‘পরাধীন মিত্রতার’ জালে। অরোরার হাতে নতুন করে বন্দী হল স্বাধীনতার দলিল। ব্র্যাক্ষ্মণ্যবাদী ভারতের পায়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সদ্য অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্তজবার নৈবেদ্য দিতে হলো। নেহেরু ডক্ট্রিন বাস্তবায়নে সার্বোভৌম বাংলাদেশকে চাণক্য চন্ডালিত্বে ঘোর প্যাঁচে বন্দী করা হল। ধর্মকর্ম সব শাপ-শাপান্ত হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশে এটি এক নতুন দুঃসময় স্বপ্নের নামে রচিত হলো শাসকগোষ্ঠীর লোভ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি। ভারতের প্রযতেœ ও প্রশ্রয়ে আওয়ামী দু:শাসন তখন স্বাধীনতার মানে ভুলিয়ে দিলো। ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বদলে প্রতিষ্ঠিত হলো এক দলীয় শাসন, পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতির দুর্বার প্রভুত্ব। চাপিয়ে দেয়া হল মুজিববাদী ইজম, এক দলীয় দু:শাসন। এমন ঘোর আঁধার পরিস্থিতিতে এল সুবহে সাদেক-১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নতুন সূর্যোদয়। রাতের আঁধারে বজ্রপাতের মতো ঘটল এক বিপ্লব, ‘এক নেতা এক দেশ এক রাতেই সব শেষ।’ স্বাধীনতার পর এটিই ছিল নতুন আলোর সন্ধান। মহামুক্তি। কিন্তু সে আলোও নিভে গেল রাজনীতিকদের শঠতা, লোভ, ভারতীয় গোয়েন্দা অপতৎপরতা আর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভ্রান্তিতে। একবারের জন্য মুখ তুলে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ, কিন্তু আবারও তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো ‘প্রতিবেশী বন্ধু’র হঠাৎ কোল ঘেঁষা পরশে, কালনাগিনীর ছোবলে। মুক্তির স্বাদ মুখে লেগেই রয়ে গেল।
এরপর ভারতীয় ঘেরাটোপে থেকে দু:সাহস দেখানোই কাল হলো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার। আবার জাতির সামনে অমানিশার কালো রাত নেমে এলো। কিন্তু পথচলা থামেনি। জুলাইয়ের অভ্যুত্থান নতুন আশার ঝড় তোলে। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নসাধে জাতি বুক বাঁধে। তরুণেরা আবারও দাঁড়ায়—হৃদয়ে দেশ, চোখে স্বপ্ন। কিন্তু এবারও ইতিহাস ফিরে আসে সেই পুরোনো খোলসে। লালসা, বিভ্রান্তি আর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মিলেমিশে সম্ভাবনার বাতি নিভিয়ে দেয় কুয়াশার ঘূর্ণিতে। আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি।
পলাশীর ষড়যন্ত্র, দিল্লির ব্র্যাক্ষ্মাণ্যবাদী চন্ডালীত্ব, এবং নিজেদের সীমাহীন লোভ,শঠতা আর অদূরদর্শিতার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত এ হতভাগা জাতি। যুগ সঞ্চিত এ সকল বঞ্চনা এই বাঙালি জাতিকে বারবার শিখিয়েছে-স্বাধীনতা শুধু পতাকার নাম নয়, এটি একটি দৈনন্দিন যুদ্ধ, সার্বক্ষণিক আত্মসম্মানের লড়াই।
উপসংহার: পলাশী থেকে বাংলাদেশ-এ কেবল ইতিহাস নয়, এ এক জাতির জলদ গম্ভীর শঠতা, প্রতারণা আর আত্মদহনের ইতিহাস। যতবার জাতি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, ততবার তার মাথা অবনত করানো হয় ষড়যন্ত্রের চাবুকে। কিন্তু ইতিহাস জানে, সচেতনতার আগুন একবার জ্বলে উঠলে ছাই হয়ে যায় শাসক, দালাল আর শঠতার আবর্জনা। এই পলাশীর মাটিতে একদিন জন্ম নেবে সত্যিকারের মুক্ত বাংলাদেশ যেখানে কেউ হবে না স্যাটেলাইট, কেউ হবে না অন্যের পদতলে পিষ্ট। থাকবে না আর কলোনিয়াল হার্মাদ আর কলোনিয়াল মানসপুত্র। তখন এ মাটির প্রতিটি কিশোর বলবে- ‘আমরা বাংলাদেশি, আমরা সিরাজের উত্তরসূরী। আমরা আর কারও ছায়ায় থাকবো না।’ আর যেন এ জাতিকে আক্ষেপ করে এমন কবিতা লিখতে না হয় -‘রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা।’ পলাশীর বৃষ্টিতে দেশ মাতৃকার চোখের যে স্বপ্ন আকিঞ্জন মুছে গেছে, তা আর আঁকা হয়ে উঠেনি। সেই অভিষ্ঠ স্বপ্ন কাজল আঁকতে আসুন সিরাজুদ্দৌলার আদর্শকে হৃদয়ে লালন করি। বাংলাদেশের মাটি অচিরেই জন্ম দিক শত-সহস্র দেশপ্রেমিক সিরাজ, নবাব সিরাজুদ্দৌলা।