জীবন সংগ্রামে জিততে পারবেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সুলতান?

সালাউদ্দীন কাজল: জীবননগর উপজেলার খয়েরহুদা গ্রামে সুলতান কবিরের জন্ম। তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ডান চোখে একেবারেই দেখেন না। আর বাম চোখে দেখেন মাত্র ৪০ ভাগ। একেবারে হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া সুলতান কবির অন্ধত্বকে জয় করে ছোটবেলা থেকেই জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছেন। ইতোমধ্যে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পঞ্চম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার পড়ালেখায় অন্ধত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন এবং সংসারে সহযোগিতা করেছেন। করোনার কারণে তার টিউশনিটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে একবেলা খাবার যোগাড় করা তার জন্য কষ্টসাধ্য একটি বিষয়। আজ বিভিন্ন বিষয়ে দৈনিক মাথাভাঙ্গার সঙ্গে কথা হয় সুলতান কবিরের।
তিনি বলেন, আমার জন্ম ১৯৯৬ সালে। চোখের সমস্যা নিয়েই আমি জন্মগ্রহণ করেছি। ডান চোখে একেবারেই দেখি না। আর বাম চোখে ৪০ ভাগ দেখি। আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একজন মানুষ। আমার পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। আমি যখন জন্ম নিই তখন আমার পরিবারের অবস্থা ছিলো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। ওই সময় আমার চোখের জন্য চিকিৎসক দেখানো তো দূরের কথা, তখন আমাদের তিনবেলা ভাত জোগাড় করাও ছিলো দূরহ ব্যাপার।
সুলতান বলেন, আমি এক চোখে দেখি না, আর এক চোখে অল্প দেখি এজন্য আমাকে অনেকেই খারাপভাবে ট্রিট করতো। সেটার জন্য আমি ছোটবেলা থেকেই হীনমন্যতায় ভুগেছি। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি আমার একটা ঝোঁক ছিলো। ক্লাস ফাইভ আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। এ সময় আমি এমন একজন টিচারের কাছাকাছি এসেছিলাম যিনি অনেক ভালোভাবে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। আমি ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই। এরপর সিক্সে ভর্তি হয়ে ছেড়া জামা পরে পার করেছি ক্লাস সেভেন। এরপর আমি ক্লাস এইটে আবারও বৃত্তি পাই। আমার বাবার আর্থিক সামর্থ না থাকায় আমার লেখাপড়ার খরচ যোগানোর জন্য আমার মা ওই সময় নিজে টিউশনি শুরু করেন।
ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় আমার বাবার বড় ধরনের একটা ব্রেন স্ট্রোক হয়। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে আমার বাবা একেবারেই অকেজো হয়ে পড়েন। তখন আমার বাবার এই অবস্থার কারণে আমাদের পুরো পরিবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলো। মায়ের মানসিক সমর্থনে মা এবং আমি দু’জনে মিলে টিউশনি শুরু করি। এভাবেই আমি এসএসসি পরীক্ষা দিই। এসএসসিতে আমার ফলাফল খুব একটা ভালো ছিলো না। এইচএসসিতে আমার বড় একটা আশা ছিলো খুব ভালো ফলাফল করে এলাকার সবাইকে চমকে দেব। উথলী ডিগ্রি কলেজে থেকে ১৭৫ জন শিক্ষার্থীর ভেতর আমি একা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে বোর্ড বৃত্তি পাই।
এরপর ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। যেহেতু আমার বাবা-মায়ের আর্থিক সামর্থ ছিলো না, এ কারণে আমি ঢাকাতে না গিয়ে রাবিকে বেঁছে নিই। আমি ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হই তখন ইংলিশ ভার্সনের পড়া ছাড়াও নতুন পরিবেশে মানিয়ে উঠতে পারতাম না। একপর্যায়ে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসি। একদিন বাসায় আসার পর মায়ের ডায়েরি পড়তে গিয়ে দুটি লাইনে আমার চোখ আটকে যায়। ওখানে লেখা ছিল, ‘আমার ছেলের পড়ালেখা করা কী আর হবে না। আমার স্বপ্ন কী ভেঙে যাবে।’ ওই লেখাটা দেখার পর আমার মায়ের সমর্থনে আমি আবারও রাজশাহীতে ফিরে যাই এবং প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হই। অনার্সে অনেক ভালো ফলাফল করেছি। মাস্টার্স পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। আমি এখন একটা চাকরিপ্রত্যাশী। চাকরির জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করছি। আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। যেখান থেকে আমি আমার নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারব, পাশাপাশি মানুষের জন্য কিছু করতে পারবো।
সুলতান কবির বলেন, এ মুহূর্তে আমার একজন পৃষ্ঠপোষক খুব প্রয়োজন। যিনি আমার প্রত্যেকটা ওয়েতে আমাকে হেল্প করবে। আমি যদি একজন ভালো পৃষ্ঠপোষক পাই এবং সে রকম ভালো সাপোর্ট পাই আমার নেক্সট স্টেজগুলোতে আমি আরও ভালো করতে পারবো।
তিনি বলেন, করোনার কারণে তার এবং তার মায়ের টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে বাড়িতে একবেলা খাবার জুটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে অর্থের অভাবে একমাত্র ছোট বোনের অনার্সে ভর্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

Comments (0)
Add Comment