পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবার আয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, ভ্যান চালানো ছেড়ে স্কুলে শিশু সাব্বির

স্টাফ রিপোর্টার: মাত্র ১১ বছর বয়সে সাব্বির আহম্মেদকে কাঁধে তুলে নিতে হয় সংসারের দায়িত্ব। বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ার পর থেকে ভ্যান চালিয়ে সংসারের খরচ জোগাতে শুরু করে সাব্বির। স্কুল ছেড়ে ভ্যানের হ্যান্ডেল ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে বাধ্য হয়। এভাবে যা আয় হয়, তা দিয়েই তাদের তিনজনের সংসার চলছিলো। শনিবার বিকেলে ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার দত্তনগর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়ে ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছিলো সাব্বির। তখন তার ভ্যানে ৫-৬ জন যাত্রী ছিলো। এ দৃশ্য দেখে চোখ আটকে যায় দত্তনগর ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) সাগর সিকদারের। তিনি ভ্যান থামিয়ে শিশুটির কথা শোনেন। এরপর সাব্বিরের অসুস্থ বাবার কাছে গিয়ে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে করণীয় ঠিক করেন। সিদ্ধান্ত নেন, তার বাড়িতে একটি দোকান করে দেবেন। আর শিশুটিকে পাঠানো হবে স্কুলে। সেই অনুযায়ী রোববার সকালে সাব্বিরকে বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেন সাগর সিকদার। শিশু সাব্বির আহম্মেদ মহেশপুর উপজেলার পোড়াপাড়া গ্রামের আব্দুল জব্বারের ছেলে। যুথি খাতুন নামের ১৪ বছর বয়সী সাব্বিরের একটি বোন আছে, সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।

আব্দুল জব্বার জানান, নিজের কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। মাত্র এককাঠা জমির ওপর এক কক্ষের মাটির ঘরে বসবাস করেন। নিজে ভ্যান চালিয়ে যা আয় করতেন, তা দিয়ে কষ্ট হলেও চলে যাচ্ছিলো। সাব্বির তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছিলো। কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। প্রায় দুই বছর আগে একদিন তিনি গ্রামের মাঠে ছাগলের জন্য ঘাস আনতে গিয়ে হঠাৎ করে জমির আইলে পড়ে যান। গ্রামবাসী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। অনেক চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফেরেন, কিন্তু তার ডান হাতটি চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যায়।

আব্দুল জব্বার জানান, এ অবস্থায় কিছুদিন জমানো টাকা, মানুষের সাহায্যে চলেছেন। এরপর যখন আর পেরে উঠছিলেন না, তখন ছেলের হাতে ভ্যানের হ্যান্ডেল তুলে দেন। ছেলে সাব্বির শিশু হওয়ায় বেশি দূরে যেতো না, তাদের গ্রাম থেকে দত্তনগর পর্যন্ত চার কিলোমিটার ভ্যান চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতো। এভাবে শিশু সাব্বির কাঁধে তুলে নিয়েছিলো সংসার।

আব্দুল জব্বার বলেন, শনিবার বিকেলে হঠাৎ করে সাব্বিরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে আসেন দত্তনগর ফাঁড়ির কর্মকর্তা সাগর সিকদার। ছোট মানুষ কোনো অন্যায় করেছে ভেবে প্রথমে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ কর্মকর্তা তার কাছে এসে জানতে চান, কী করলে তিনি সংসার চলার মতো আয় করতে পারবেন। এ সময় প্রতিবেশীরাও এগিয়ে আসেন। সবাই মিলে ঠিক করেন, বাড়িতে একটি দোকান হলে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে চালাতে পারবেন।

তাৎক্ষণিক সাগর সিকদার দোকান করার জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়ে যান। বলে যান, পরদিন এসে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসবেন। সেই কথা অনুযায়ী, তিনি রোববার সকালে এসে ছেলেকে নিয়ে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান, সেখানে তাকে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ছেলে ভ্যানের হ্যান্ডেল ছেড়ে আবার কলম ধরলো, এটা ভেবে খুব ভালো লাগছে আব্দুল জব্বারের।

সাব্বির আহম্মেদের সহপাঠী রাকিব হোসেন বলে, তারা একসঙ্গে পড়তো। মাঝে সাব্বির স্কুলে যেতো না। এটা তাদের কাছে খারাপ লাগতো। আবার যাবে শুনে ভালো লাগছে।

প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম জানান, দরিদ্র হলেও একটা সাজানো সংসার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। পুলিশ কর্মকর্তার এ উদ্যোগে সংসারটা আবার সচল হবে।

সাব্বির আহম্মেদের স্কুল পোড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মইনুল ইসলাম জানান, বাচ্চাটি স্কুল ছেড়ে গেলে তারা একাধিকবার খোঁজ নিয়েছেন। তাকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সংসারের বোঝা কাঁধে থাকায় ফিরতে পারেনি। পুলিশ কর্মকর্তার সহযোগিতায় বাচ্চাটি স্কুলে ফেরত এসেছে। তারা বাচ্চাটির সার্বিক খোঁজখবর রাখবেন বলে জানান।

এ বিষয়ে এসআই সাগর সিকদার বলেন, পাঁচ থেকে ছয়জন যাত্রী নিয়ে শিশুটিকে ভ্যান চালাতে দেখে তার খারাপ লেগেছিলো। তাই দাঁড় করে পরিবারের খোঁজ নেন। সবকিছু জেনে বাবাকে একটি দোকান আর ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। এটা করতে পেরে তার ভালো লাগছে।

Comments (0)
Add Comment