আলমডাঙ্গা ব্যুরো: অবশেষে প্রাণের দাবি পূরণ হলো চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গাবাসীর। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে বেনাপোল-ঢাকা রুটের ৭৯৫/৭৯৬ আন্তনগর বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেন নিয়মিতভাবে আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি দিচ্ছে। আপ ও ডাউন উভয় পথেই যাত্রীরা এখন তাদের প্রিয় স্টেশন থেকে উঠতে ও নামতে পারবেন। এ যেন এক স্বপ্নপূরণের দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই স্টেশন চত্বরে উৎসবের আমেজ। উৎসবমুখর স্টেশন, শবর। হাতে নানা সংগঠনের ব্যানার, মুখে হাসি আলমডাঙ্গার মানুষ যেন নতুন করে সৌভাগ্যের বার্তা পেয়েছে। উপজেলা ও জেলা বিএনপি ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা, নাগরিক কমিটি, স্টেশন রক্ষা কমিটি, ব্যবসায়ী সমিতি, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সংগঠন ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ট্রেনকে বরণ করে নিলেন। এই বাঁধভাঙ্গা আনন্দ উল্লাসের ভেতর উপস্থিত ছিলেন আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলাম ও আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মাসুদুর রহমান-পিপিএম। উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের উপস্থাপনায় বক্তব্য রাখেন-আলমডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আক্তার হোসেন জোয়ার্দ্দার, পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজুর রহমান পিন্টু, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম রোকন, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ওল্টু। আরও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসাস, আলমডাঙ্গা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিজা, যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিবুল করিম চনচল, আলমডাঙ্গা বণিক সমিতির সভাপতি আরেফিন মিয়া মিলন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন, গার্মেন্টস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হক রনি, বৃহত্তর কাপড় পট্রি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আব্দুল কাদির, মুদি ও মনোহারী ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক আলাউদ্দিন, কলেজপাড়া কল্যাণ কমিটির সম্পাদক হাজী মীর শফিকুল ইসলাম, বৈসম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রাকিব মাহমুদ, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির পক্ষে নাসির উদ্দিন এ্যাটোম, ক্রীড়া সংগঠক মিজানুল হক, মন্ডল স্পোটর্সের স্বত্তাধিকারী মামুনুর রশীদ ম-ল প্রমুখ। এই আনন্দ শুধুই ট্রেন থামার নয়, এই আনন্দ দীর্ঘদিনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিজয়ের। কেউ ভুলে যাননি কতটা কষ্ট আর ধৈর্যের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে এসব দিন। কেউ ভুলেনি রোদে-ঝড়ে দাঁড়িয়ে করা মানববন্ধন, রেল অবরোধ আর দিনের পর দিন করা স্মারকলিপি পাঠানো। ১৮৬২ সালে স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে এতদিন বেনাপোল এক্সপ্রেস থামতো না। ফলে যাত্রীদের ১৮ কিলোমিটার দূরের চুয়াডাঙ্গা বা ২২ কিলোমিটার দূরের পোড়াদহ স্টেশনে যেতে হতো। বিশেষ করে অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং নারী যাত্রীদের জন্য এটা ছিল ভোগান্তির অন্য নাম। মধ্যরাতে ট্রেন ধরার জন্য কেউ বসে থাকতেন নির্জন চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে, কেউবা নিরাপত্তাহীনতায় আতঙ্কে কাঁপতেন। আজ এই বেদনার অবসান হলো। রেলওয়ের দপ্তর থেকে পাঠানো আদেশ অনুযায়ী, এখন থেকে সপ্তাহে ছয় দিন-শুধু বুধবার বাদে আপ ট্রেন বিকেল ৩টা ৩৯ মিনিটে পৌঁছে ৩টা ৪১ মিনিটে এবং ডাউন ট্রেন রাত ৩টা ৩৪ মিনিটে পৌঁছে ৩টা ৩৬ মিনিটে আলমডাঙ্গা স্টেশন থেকে ছাড়বে। আন্দোলনে সম্পৃক্তরা বলেন, ‘এটা শুধু ট্রেন থামা নয়, এটা আলমডাঙ্গাবাসীর সম্মান ফিরে পাওয়া। আমরা একসঙ্গে ছিলাম, একসঙ্গে আছি-এই ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।’ শুধু আলমডাঙ্গা নয়, পার্শ্ববর্তী মিরপুর, গাংনী, হরিণাকুন্ডু অঞ্চলের মানুষও এই সিদ্ধান্তে উপকৃত হবেন। এতে যেমন যাত্রীদের সুবিধা হবে, তেমনি রেলওয়ের রাজস্ব বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। আজ আলমডাঙ্গা স্টেশন শুধু একটি ট্রেন থামার নয়, এটি মানুষের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাওয়ার দিনে পরিণত হয়েছে। এ এক আন্দোলনের সফল পরিণতি, এ এক গর্বিত অধ্যায়ের সূচনা বলেই ভাবছেন আলমডাঙ্গাবাসী। নেপথ্যের নীরব নায়ক: সাফল্য কোনো একক প্রচেষ্টার ফসল নয় এটি বহু মানুষের নিঃশব্দ নিবেদন, শ্রম আর ভালোবাসার সম্মিলিত প্রতিচ্ছবি। বেনাপোল এক্সপ্রেসচেপে আলমডাঙ্গায় স্টপিজের মাধ্যমে এই সত্যটিই আবারও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। দুজন মানুষের প্রাণের নিরলস পরিশ্রম, যাদের কথা বলা না হলে কৃতজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই নিঃশব্দ নায়ক হলেন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান ও বেজার মহাপরিচালক (প্রশাসন) যুগ্ম সচিব আবু হেনা মো. মুস্তাফা কামাল। তারা দুজন আলমডাঙ্গার সন্তান। গত বছর ১২ নভেম্বর আলমডাঙ্গাবাসীর পক্ষে যুগ্ম সচিব আবু হেনা মো. মুস্তাফা কামাল বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের নিকট বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা বিরতির জন্য লিখিত দরখাস্ত দেন। পরবর্তীতে সবগুলো সরকারি আদেশ ওই দরখাস্তের প্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও তিনি ব্যক্তিগতভাবে রেলভবনসহ রেলওয়ের আমলাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। আরেক নায়ক এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান। রেলওয়ের আমলাতান্ত্রিক গোর আজাব, নানা অচলায়তন ভেঙে আলমডাঙ্গায় বেনাপোল এক্সপ্রেসের স্টপিজ জয়ে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তারা ছিলেন পর্দার আড়ালে, কিন্তু প্রতিটি সংকট ও প্রয়োজনে তাদের উপস্থিতি ছিল সুস্পষ্ট-যেন বাগানের বটবৃক্ষের গোড়ায় পানির সজীব ধারার মতো। চারা গাছে পানি, প্রয়োজনমতো সার, সময়মতো ছাঁটাই-এই নিবিড় পরিচর্যার ফলে ফুটেছে যে সাফল্যের ফুল, তার গন্ধ ছড়িয়েছে ৩ জুলাইয়ের উৎসবজুড়ে। বাগানের চারা গাছে পানি দিয়ে ফুল ফোটানোর মতো, এই নেপথ্যের কারিগররাই গড়ে তুলেছেন আজকের আনন্দের দিন। তাদের যোগাযোগ দক্ষতা, সমন্বয় ক্ষমতা এবং নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টাই এই আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করেছে। তারা ছিলেন অদৃশ্য শক্তি হিসেবে।