আলমডাঙ্গা ব্যুরো: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রধান সেচ খাল জিকে ক্যানেলের দুই পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা সরাতে শুরু হয়েছে দখল উচ্ছেদ অভিযান। গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে এ অভিযান পরিচালিত হয়। উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহম্মেদ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশীষ কুমার বসু এবং উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নাজিম উদ্দিন। অভিযানে বেশ কয়েকটি কাঁচা ও আধাপাকা স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। আগেভাগে সংবাদ পেয়ে অনেকেই স্বেচ্ছায় দোকানপাট ও ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে জিকে ক্যানেলের দুই তীরে প্রভাবশালীসহ নিম্নআয়ের মানুষেরা অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নিয়েছিলেন। বারবার উচ্ছেদ করলেও আবার তা দখল হয়ে যেত। এমনকি কেউ কেউ কুমার নদের (জিকে খাল) পানির ভেতরেও পিলার বসিয়ে ঘর তুলেছিলেন। ফলে খালের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছিল, যা কৃষি সেচে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিলো। নাগরিক উন্নয়ন কমিটির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানানো হচ্ছিল। কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই খাল আলমডাঙ্গার প্রাণ। এর অস্তিত্ব রক্ষা মানেই কৃষি ও পরিবেশ রক্ষা। আজকের উচ্ছেদ অভিযানে আমরা আশার আলো দেখছি।’
আলমডাঙ্গা নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘নদীমাতৃক দেশে নদী আমাদের প্রাণের প্রবাহ। মনুষ্য সভ্যতা সবই নদী কেন্দ্রিক। সেই নদী কেউ কেউ হত্যা করতে উদ্যত। তাদের বোঝা উচিত এ তো শুধু নদী হত্যা না, এ সভ্যতাকে হত্যার শামিল। আমরা বেশ কিছুদিন ধরে নদী বাঁচাও নিজে বাঁচো আন্দোলন করে আসছিলাম। এ নদী ও এই নদীর তীরে আলমডাঙ্গা শহরকে কেন্দ্র করে আমাদের অনেক স্বপ্ন আছে। অবৈধ দখলদারমুক্ত করে নদীর (জিকে সেচ প্রকল্পের খাল) দুপাড়ে বৃক্ষরোপণ করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীর দুপাড় দিয়ে মর্নিংওয়ার্কের সুব্যবস্থার দাবি রয়েছে।’
শরিফুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ‘টেমস নদীর তীরে যেমন লন্ডন শহরের অবর্চনীয় সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে, তেমনি কুমার নদকে নিয়েও আমাদের স্বপ্ন রয়েছে। সময় এসেছে সে স্বপ্নের বাস্তবতা দেয়ার।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহম্মেদ বলেন, ‘এই জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করেছিল সেচ প্রকল্পের জন্য। কিন্তু তা অবৈধভাবে দখল হয়ে গিয়েছিল। আজকের অভিযান সেই জায়গাকে উদ্ধার করতেই। আমরা চাই, এই জায়গায় বৃক্ষরোপণসহ পরিবেশবান্ধব প্রকল্প নিতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনুরোধ করছি-কেউ যেন সরকারি জায়গা দখলে না নেন। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ আলমডাঙ্গা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক ইকবাল হোসেন মিয়া বলেন, ‘পুরুষের বুকের মত মুছে যাওয়া নদীগুলির সমতল বুক এখন কৃষি জমিন। বাকীগুলোর অবস্থা মুমূর্ষু। মুমূর্ষু নদীর কঙ্কালসার দেহাবশেষ দেখে বোঝার উপায় নেই যে ৫০ বছর আগেও এ নদীগুলি ছিল উদ্ভিন্ন যৌবনা। গ্রামের খাল-বিল আগে থেকেই দখল হয়ে গেছে। খালবিল হারিয়ে যাওয়ার ফলে স্থানীয় তাপমাত্রা আর ঠান্ডা বাতাসের ভারসাম্যও ভেঙে পড়েছে। গ্রামের খালবিলও দখলমুক্ত করা দরকার।’
নদী ও খাল দখলের ভয়াবহ কুফল: বাংলাদেশের নদী ও খাল দখলের ফলে একদিকে যেমন পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হয়, তেমনি জলাবদ্ধতা, খরা, কৃষি উৎপাদনে ঘাটতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্ম দেয়। জিকে ক্যানেল শুধু একটি খাল নয়, এটি এ অঞ্চলের কৃষির শিরাধমনী। এর দখল মানেই জনজীবনে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করা।
আশার কথা: এ ধরনের প্রশাসনিক উদ্যোগ, জনসচেতনতা ও নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আলমডাঙ্গার মানুষ দেখিয়ে দিচ্ছে নদীকে ভালোবাসলেই বাঁচবে জনপদ, বাঁচবে ভবিষ্যৎ। এ অভিযান চলাকালীন আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছিলো। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর টিমকেও টহল দিতে দেখা যায়। অন্যান্যের মধ্যে আলমডাঙ্গা নাগরিক উন্নয়ন কমিটির নেতৃবৃন্দকে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।