আলমডাঙ্গায় বাল্যবিয়ের পিড়িতে না বসা দরিদ্র পরিবারের মেয়ের মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন

রহমান মুকুল: ওয়াদখুলী জান্নাতীরা ৩ বোন। বাবা বেসরকারি কলেজের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী। ৩ বোনই পড়ালেখা করেন। অভাবের সংসারে মেয়েকে পাত্রস্থ’ করার দুশ্চিন্তা থাকেই। খুব স্বাভাবিকভাবে এ চিন্তা ওয়াদখুলী জান্নাতীর মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের ছিলো। জান্নাতী তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়েন। নানা-নানী বিয়ে ঠিক করেছেন তার। পাত্র প্রবাসী। জান্নাতীর নানা অসুস্থ। নাতনিকে বিয়ে দিয়ে নাত-জামাইয়ের মুখ দেখে মরতে চান তিনি। মায়েরও অমত নেই। জান্নাতী ছাড়াও তাদের আরও দুটি মেয়ে আছে। কিন্তু জান্নাতী বেঁকে বসলেন বিয়েতে। এত অল্প বয়সে বিয়ে করতে মোটেই সায় নেই তার। ভালোভাবে লেখাপড়া করে নিজের পায়ের দাঁড়াতে চান তিনি। কেঁদে কেটে নিজের ইচ্ছের কথা বলেছিলেন বাবাকে। মেয়ে যেহেতু লেখাপড়ায় যথেষ্ঠ ভালো, বিশেষ করে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন জান্নাতী। তাই মেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন বাবা। এ ঘটনার কয়েক মাস পর জেএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এ পরীক্ষায়ও তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য জেএসসির এ প্রজ্জ্বলতম রেজাল্টের পর আর কোনো স্বজন জান্নাতীর বিয়ের ঘটকালি করতে আসেননি। তারপর আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সেই অদম্য মেয়েটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এলাকাবাসীকে গর্বিত করলেন। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার আসাননগর গ্রামের খোরশেদ আলম বাবলু ও ফাতেমা আক্তার দম্পতির সন্তান জান্নাতি। তারা ৩ বোন। তিনি বড়। বাবা খোরশেদ আলম বাবলু সদ্য সরকারিকৃত আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ির সামান্য জমি ব্যতীত চাষাবাদের এক চিলতে জমিও নেই। স্বল্প বেতনের চাকরিই সম্বল। বাবার স্বল্প আয়ে তাদের সংসার চলে। চলে ৩ বোনের লেখাপড়া। মা ফাতেমা আক্তার নিপুণ হিসাবরক্ষকের মতো চালিয়ে নেন সংসার।
১ম বার ভর্তি পরীক্ষায় অসফল: জান্নাতী ১ম বার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন। তবে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অসফল হলেও ১ম বারই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ভর্তি হয়েছিলেন জুওলোজিতে। এ বছর ২য় বারের মত আবার তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। ২য় বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে। ২য় বার পরীক্ষার দরুন ৫ নম্বর কেটে নেয়ার পরও তার জাতীয় মেধা তালিকায় স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৭০। জান্নাতি বলেন, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছি ডাক্তার হওয়ার। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়ায় এ স্বপ্ন দেখার মূল্য সমাজের নিকট ছিলো না। এমনকি আত্মীয়-স্বজনের নিকটও এ স্বপ্নের আবেদন ছিলো না। তারপরও স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। ভেতরে ভেতরে এ স্বপ্ন লালন করে গেছি। সারারাত পড়েছি।
দারিদ্র ও অনিয়মের সাথে লড়েছি : শুধু দারিদ্র না নানা অনিয়মের সাথেও লড়াই করতে হয়েছে। আমি রক্তাক্ত হয়েছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনিয়মের তীর আমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এমনকি পরীক্ষা হলেও এ অপ্রিয় ঘটনা চরম মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার নির্ধারিত সময় শেষ। আমাদের নিকট থেকে উত্তরপত্র নিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিদর্শক শিক্ষক কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে সময় শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে ১০ মিনিট করে অতিরিক্ত সময় দিয়েছিলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। শুধু কী এইচএসসি পরীক্ষা? মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েও অনিয়ম দেখেছি। যন্ত্রণায় হৃদয় ছিড়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারিনি। কারণ আমার আব্বার সামাজিক অবস্থান অতটা সুদৃঢ় না। অবশ্য এসব অনিয়ম আমার ভেতরে বড় হওয়ার জেদ সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষকদের সহযোগিতা: জান্নাতী বলেন, আমার এ সাফল্যের পেছনে শিক্ষকদের অনেক অবদান রয়েছে। বিশেষ করে আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুজ্জামান ও আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের শিক্ষক ফারুক হোসেনের সহযোগিতা কোনোদিন ভোলার না। অন্যান্য শিক্ষকরাও যথেষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। বাবা কলেজের স্টাফ। তাই প্রাইভেট পড়িয়েছেন ফ্রি। হাইস্কুলে পড়াকালীনও প্রাইভেট শিক্ষকরা অর্ধেক টাকা নিয়েছেন। আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবিদ গোলাম ছরোয়ার মিঠু ও প্রভাষক তাপস রশীদ নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করতেন। তাদের কাছেও কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণার পাশাপাশি শিক্ষকদের দিকনির্দেশনামূলক পরামর্শ আমার সাফল্যে সবচে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের ভালোবাসা ও স্নেহ সবসময় আমাকে সাহস যুগিয়েছে।
সাফল্যের মূলমন্ত্র: লক্ষ্যে স্থির থাকলে এবং সঠিক পরিকল্পনায় আন্তরিকভাবে পড়াশোনা করলে সাফল্য নিশ্চিত। দারিদ্য কিংবা অন্য সমস্যা তাকে স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। অনেকে বলেন, গ্রামের শিক্ষার্থীরা খুব বেশি সাফল্য পায় না। কারণ গ্রামে তেমন সুযোগ নেই। তাদের এ কথা হয়তো কিছুটা সঠিক। তবে সবটা না। আমিই তার প্রমাণ। আমি উপজেলা মফস্বল কলেজে পড়লেও বসবাস করেছি গ্রামে। গ্রাম থেকেই আমি সাফল্য পেয়েছি।
বাবার কথা: জান্নাতীর বাবা খোরশেদ আলম বাবলু বলেন, জান্নাতী ছোটবেলা থেকেই ব্রিলিয়ান্ট। পড়াশোনার প্রতি খুব নিষ্ঠা ছিলো। আমি খুব ছোট চাকরি করি। ও এতোটা মেধাবী না হলে আমার পক্ষে পড়ানো সম্ভব ছিলো না। শুধু জান্নাতী না আরও দুই মেয়ে পড়ছে। জান্নাতীকে সাইন্সে পড়াতে গিয়ে অনেক শিক্ষক সহযোগিতা করেছেন। কলেজের কোনো শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে টাকা নেননি। হাইস্কুলের শিক্ষকরাও খুব সহযোগিতা করেছেন। আজকের আনন্দের দিনের তাদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করছি। তবে কোনো আত্মীয় মেয়ের লেখাপড়ার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি।
তিনি আরও বলেন, মেয়েকে শুধু একটা কথায় বলবো একদিন তুমি অনেক বড় হবে। কিন্তু মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলবে না। কেউ যেনো টাকার অভাবে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে তোমার নিকট থেকে ফিরে না যায়। অক্ষম রোগীদের সাধ্যমতো আর্থিক সহযোগিতাও করবে।
মায়ের কথা: মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে অনেকে মন খারাপ করে দেয়ার মতো কথাবার্তা বলেছেন। বিয়ে দিয়ে দিতে উপদেশ দিয়েছেন। এমনকি মেয়ের সামনেও অনেকে কটু কথা বলতেন। আত্মীয়রা কেউ সহযোগিতা করেনি। কিন্তু আমাদের মেয়ে এখন মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করার সংবাদ পেয়ে সকলেই খুব খুশি। আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসছেন। মেয়ের এ সাফল্যে তিনিও খুব খুশি ও গর্বিত। আজকে আমার এত খুশি লাগছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
হাইস্কুলের শিক্ষকের কথা: আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি) মজনুর রহমান বলেন, জান্নাতী আমাদের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পেয়েছিলো। পড়াশোনার প্রতি তার একাগ্রতা আমাদের মুগ্ধ করতো।
কলেজ অধ্যক্ষের কথা: আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কৃষিবীদ গোলাম ছরোয়ার মিঠু বলেছেন, জান্নাতীর সাফল্যে আমরা গর্ববোধ করছি। সে আমাদের কলেজ স্টাফের কন্যা। সে কারণে আমাদের আনন্দ অনেক গুণ বেড়ে গেছে। শিক্ষকরা সবসময় তার পড়াশোনার খোঁজখবর রেখেছেন। সে আমাদের কলেজের মুখ উজ্জ্বল করেছে।

Comments (0)
Add Comment