কবি নজরুল চর্চার মাধ্যমে সম্প্রীতির সুন্দর সমাজ গড়া সহজ  

কার্পাসডাঙ্গায় ৩ দিন ব্যাপী জাতীয় কবি নজরুল মেলা উদ্বোধনকালে আলী আজগার টগর এমপি

কার্পাসডাঙ্গা/ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত কার্পাসডাঙ্গায় শুরু হয়েছে তিন দিনের কবি নজরুল মেলা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এ মেলা উদ্বোধনকালে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর বলেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশে এনে তাকে যথযথ সম্মান দিয়ে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলার প্রতি ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিলো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জাতির জনকের আদর্শ ছিলো অভিন্ন। সাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার যে স্বপ্ন এই দুই মহান পুরুষ দেখে গেছেন তা জীবনকে বাজি রেখে ক্রমন্বয়ে বাস্তবায়ন করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বনন্দিত নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কার্পাসডাঙ্গার মিশনপাড়ায় আয়োজিত কবি কাজী নজরুল মেলায় দেশ বিদেশের বহু কবি সাহিত্যিক কণ্ঠশিল্পীসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই উপস্থিত হয়েছেন। এ মেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, বিদ্রোহ ও তারুণ্যের কবি আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাকাব্যে ধুমকেতুর মতোই তার আবির্ভাব। কবি বিদ্রোহ করেছিলেন সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ-নির্যাতন আর দুঃখ-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কবিতা লেখার অপরাধে কারারুদ্ধ হন। বন্দি করেও থামানো যায়নি তার লেখা। চরম আর্থিক অনটন আর দুঃখ-দারিদ্র্যেও তার বাল্যকাল কাটে বলে তাকে সবাই দুখু মিয়া বলে ডাকতো। কবি ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১২ সালে কবি আসানসোলের একটি হোটেলে স্বল্প বেতনে কাজ করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি ও কবি পরিবারকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ১৯৭২ সালে এবং কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। তিনি প্রায় চার হাজারের মতো গান রচনা করেন। তার লেখা গান আজও খুব জনপ্রিয়। আমাদের রণ সংগীত ‘চল চল চল’র রচয়িতা তিনি।

গণমানুষের এই কবি চিরকাল আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উদ্বোধক চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর। নজরুল চর্চা কেন্দ্র বাঁশরী ও নজরুল স্মৃতি সংসদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত কবি কাজী নজরুল মেলায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, এই কার্পাসডাঙ্গায় কবির নামে একটি হাসপাতাল, নজরুল গবেষণা ইনস্টিটিউট ও নজরুল পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের সভাপতি এমএ গফুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল-মামুন, দামুড়হুদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ, উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান হাজি সহিদুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব সভাপতি দৈনিক মাথাভাঙ্গা সম্পাদক সরদার আল আমিন, বাংলা একাডেমির সদস্য ও ছড়াকার কবি আতিক হেলাল, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি নজমুল হেলাল, ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি শফিক উর রহমান। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুন্সি আবু সাঈফ। পুলিশ সুপার তার বক্তব্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবে কোন কবিতায় জয় বাংলা লিখেছিলেন তার বর্ণনা টেনে তিনি সাম্যবাদ সমাজ গঠনে যে অবাদ রেখে গেছেন তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের রেখে যাওয়া সাহিত্যযজ্ঞ চর্চার মাধ্যমে সমাজকে সুন্দর সম্প্রীতির করে গড়ে তোলা সম্ভব। ফলে আমাদের কবি কাজী নজরুল চর্চা বাড়াতে হবে। প্রধান বক্তা মুন্সি আবু সাঈফ চমৎকারভাবে কবি নজরুলের নানা দিক তুলে ধরে বিষদে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কবির বেশকিছু কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কবির বিশালতাকেও মেলে ধরেন।  শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নজরুল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন বাঁশরী নজরুল চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি ড. ইঞ্জিনিয়ার খালেকুজ্জামান, সাবেক চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ভুট্ট, কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদুর রহমান মুকুল, কুড়ুলগাছি ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন, কার্পাসডাঙ্গা নজরুল সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংগঠনের নেতা রবিউল হোসেন শুকলাল, আটচালাঘর মালিক প্রকৃতি বিশ্বাস বকুল, আ.লীগ নেতা শিক্ষক আহম্মেদ আলী, আশাবুল হক আশা, শওকত আলী, শহিদ বিশ্বাস, ইলিয়াস মালিতা, সহিদুল সর্দ্দার, ইউনুচ আলী, আব্দুল হামিদ, ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মন্টু, বিল্লাল হোসেন, আব্দুর রাজ্জাক, নূর মোহাম্মদ ভগু, মনিরুজ্জামান মনি, আপেল হোসেন, কবি আকলিমা খাতুন, পুরোহিত উজ্জ্বল দিপক বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন, গেগার, শিক্ষক আবু বক্কর, মিজানুর রহমান মিজান, আশাদুল হক, শিল্পী রঘুনাথ পাল, যুবলীগ নেতা মোস্তাফিজ কচি, বখতিয়ার খলজি বকুল, শফিউদ্দিন বাবু, আক্তার আলী, জাব্বার খাবলী, ছাত্রলীগ নেতা সানাউল কবির শিরিন, মাহবুবুল আলম পলাশ, সঞ্জু প্রমুখ। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী টিটো মুন্সি। এর আগে অতিথিরা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। কবি সমাবেশ উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি কৃষি মন্ত্রণালয়ের এপিএ পুল ড. হামিদুর রহমান। সন্ধ্যা ৬টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কবিতা আবৃত্তি করেন বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী টিটো মুন্সি। সংগীত পরিবেশন করেন বাঁশরীর একটি নজরুল চর্চা কেন্দ্রের শিল্পী ও কার্পাসডাঙ্গা নজরুল স্মৃতি সংসদের শিল্পী। জেলা অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনায় নাটক রিক্তের বেদন পরিবেশিত হয়। মেলায় বিভিন্ন রকমের স্টল, বাচ্চাদের খেলার নাগরদোলা, নজরুলের লেখা বইয়ের দোকান, পরিবেশবান্ধব বন্ধু চুলা, নার্সারির দোকান, স্বাস্থ্য সেবাসহ বিভিন্ন স্টল মেলায় বসানো হয়েছে। আগামীকাল ১৭ তারিখ সকালে নজরুলের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা ও দড়িটানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে।

মেলা আয়োজকেরা বলেছেন, এটি অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে আমাদের জাতীয় কবি চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় সপরিবারে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে স্ত্রী প্রমীলা, বড় ছেলে বুলবুল ও শাশুড়ি গিরিবালাকে নিয়ে কার্পাসডাঙ্গায় প্রায় দু’মাস অবস্থান করেন। কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালীন কবি অবসর সময়ে মিশন স্কুলের বাগান সংলগ্ন ভৈরব নদীর ঘাটের শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে রচনা করেছেন অনেক গান, কবিতা ও প্রবন্ধ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘লিচুচোর’, ‘কলসী গেল ডুবে’, ‘কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়’ ও ‘পদ্ম গোখরো’ ইত্যাদি। জাতীয় কবির স্পর্শ ধন্য সেই ভৈরব নদী পাড়ের স্নানঘাটের সিঁড়িটির অংশ বিশেষ এখনো বিদ্যমান আছে।

Comments (0)
Add Comment