চুয়াডাঙ্গায় ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে বিচুলি : গো-খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা

অশনির প্রভাবে টানা বৃষ্টির কারণে আগেভাগে ধান কেটে বিপাকে কৃষকরা

সালাউদ্দীন কাজল: ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে চুয়াডাঙ্গায় টানা বৃষ্টির কারণে অনেক কৃষকের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা বৃষ্টির পর কৃষকরা ধান রক্ষা করতে পারলেও বৃষ্টিতে ধানের বিচুলি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। মাঠেই পচে নষ্ট হয়েছে গবাদি পশুর প্রধান খাদ্য বিচুলি। কৃষকরা জানান, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকার কারণে আগে-ভাগে ধান হেফাজত করতে ব্যস্ত ছিলেন তারা। তাই বিচুলির দিকে খুব একটা নজর দিতে পারেননি। এ কারণে কৃষকদের কাছে গরুর খাদ্য বিচুলি মজুদ নেই। ফলে আগামী ১-২ মাস পরই এলাকায় গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন গরু পালনকারীরা। গৃহপালিত এসব গবাদি পশুর খাদ্যের যোগানে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে কৃষকরা। প্রাণিসম্পদ বিভাগও আশঙ্কা করছে, কৃষকরা বিচুলি সংরক্ষণ না করতে পারায় আগামীতে এলাকায় গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে।

চুয়াডাঙ্গার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে রয়েছে দেশি ও বিদেশী জাতের ২ থেকে ৩ টি করে গরু। এমন কোন বাড়ি নেই যে তাদের বাড়িতে গরু-বাছুর নেই। এছাড়া জেলাতে প্রায় সাত শতাধিক ছোট-বড় গরুর খামার রয়েছে এবং কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে মৌসুমি খামারিসহ ব্যবসায়ীরাও গরু পালন করে থাকেন। এসব গবাদি পশু প্রতিপালনে খোলা মাঠে বেঁধে ঘাস খাওয়ানো হয়। এভাবে দুগ্ধগাভী ও এঁড়ে গরু মোটাতাজা করে থাকেন কৃষকরা। কিন্তু কিছুদিন আগে টানা বৃষ্টির কারণে পানিতে তলিয়ে গেছে মাঠ। ফলে গবাদি পশুর দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। এছাড়া বেড়েছে নেপিয়ার ঘাসের দামসহ কেনা গো-খাদ্যের দাম। এ কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন গৃহপালিত পশু মালিকরা। তাদের গরুগুলো বাঁচাতে নানা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। কেউ কেউ গরুর খাদ্য যোগানে ব্যর্থ হয়ে কম দামে গরু বিক্রি করে দেবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে করে ক্ষতির শিকার হবেন গরু পালনকারীরা।

সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা, আলমডাঙ্গা উপজেলা, দামুড়হুদা উপজেলা এবং জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে পানিতে বিচুলি নষ্ট হওয়ার চিত্র দেখা গেছে।

দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের কৃষক ও গরু পালনকারী হামিদুল ইসলাম জানান, ধান কাটার মৌসুম শুরুর পর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এতে ধান ক্ষেতে পানি জমে গেছে। কৃষকরা ধান ঘরে তুলতেই ব্যস্ত। তাই বিচুলির প্রতি তারা নজর দিতে পারেনি। তিনি বলেন, কৃষকরা ধান ক্ষেতেই বিচালি শুকাতো। কিন্তু ক্ষেতে পানি থাকায় সেখানে বিচালি শুকানোর মতো পরিস্থিতি নেই। ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই বিচালিগুলো রোদে শুকোতে দিলে এক-দুইদিনের মধ্যে শুকিয়ে যেতো। পরে সেগুলো গো-খাদ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হতো। যাদের গরু আছে তারা সেগুলো নিজেদের গরুকে খাওয়াতেন আর যাদের গরু নেই তারা সেগুলো বিক্রি করতে পারতেন।

লোকনাথপুর গ্রামের কৃষক মিনারুল হক বলেন, নিজেরা ধান চাষ করে যেটুকু খড় পাই তা দিয়ে কয়েক মাসের গরুর খাদ্যের যোগান হয়। তারপর কৃষকদের কাছ থেকে বিচুলি কিনে সংরক্ষণ করি। কিন্তু এবার কৃষকদের বিচালি মাঠে পচে গিয়েছে। ক্ষেতের ধান ঘরে তোলা নিয়েই হিমশিম খেতে হয়েছে কৃষকদের। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকার কারণে ক্ষেতেই বিচুলি ফেলে রাখা হয়েছে। বিচুলি সংকটের প্রভাব সামনে কোরবানির ঈদেও পড়বে।

জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের গরু পানলকারী বেল্টু বলেন, বিচুলি ভিজলে বা পানিতে থাকার পরে সেই বিচুলি শুকিয়ে নিলে তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এ জন্য সেগুলো খেতে দিলে গরু খায় না।

দেহাটি গ্রামের গরু ব্যবসায়ী আকুল হোসেন জানান, কোরবানীর ঈদের জন্য গরু এনে এক থেকে দেড় মাস পালনের পর বাজারে বিক্রি করে থাকি। গরু পালনের জন্য স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকেই বিচুলি কিনি। কিন্তু এবার বিচুলি সংরক্ষণ করতে না পেরে ধান ক্ষেতেই বিচুলি পচে নষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এক মাস আগে প্রতি কাউন (৫১২০ আটি) খড় ৩ হাজার টাকায় কিনতাম। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ৬-৭ হাজার টাকা হয়েছে।

অনন্তপুর গ্রামের সজল আলী বলেন, আমি ৫টি গরু পালন করেছি। বাড়িতে কোনো বিচুলি নেই। বাজারের কেনা খাবারের দাম দ্বিগুন বেড়েছে। খাদ্যের যে দাম এতে গরুগুলোকে কেনা খাদ্য খাওয়ানো খুব কঠিন। চিন্তায় আছি কিভাবে গরুগুলো পালন করবো। নিজে একবেলা ভাত না খেলেও চলবে। কিন্তু গরুর তো না খাইয়ে রাখা যাবে না।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা জেলার চার উপজেলায় ৩৬ হাজার ৭০৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন কৃষকরা। কৃষকরা যদি ঠিকমতো বোরো ধানের বিচুলি সংরক্ষণ করতে পারতেন তাহলে প্রতি বিঘায় ৬ থেকে ৮ কাউন বিচালি হতো। কিন্তু অতি বৃষ্টির কারণে এবার প্রতি বিঘায় ২-৩ কাউনের উপর বিচালি সংরক্ষণ করতে পারেননি কৃষকরা।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, কোরবানী ঈদ উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গাতে প্রায় আড়াই লক্ষ গরু পালন করা হয়েছে। এসব গরুর জন্য চুয়াডাঙ্গাতে এবার বিচালির সংকট রয়েছে। এ কারণে অন্যান্য জেলা থেকে খামারিদের বিচালি সংগ্রহ করে গো-খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে খামারিদের বিচালি সংরক্ষণের জন্য উপদেশ দেয়া হয়। কিভাবে বিচালি সংরক্ষণ করতে হবে সে প্রশিক্ষণও আমরা দিয়ে থাকি।

Comments (0)
Add Comment