অতিকথনে সর্বনাশ

কথার হিসাব না থাকায় হিরো থেকে রাতারাতি জিরোয় পরিণত হয়েছেন অনেকেই
স্টাফ রিপোর্টার: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতাযুদ্ধে মহান শহীদদের নিয়ে কটূক্তি এবং নারীবিদ্বেষী বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো এমপি, মন্ত্রী ও মেয়র রেহাই পাননি। গ্রহণ করা হয়েছে দলীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা। হারাতে হয়েছে মন্ত্রী, এমপি ও মেয়র পদ। যার সর্বশেষ উদাহরণ তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। যেসব এমপি, মন্ত্রী ও মেয়র এ শাস্তির আওতায় এসেছেন তারা প্রত্যেকেই নিজ মুখনিঃসৃত বেসামাল কথাবার্তারই বলি হয়েছেন। ‘মুখে লাগাম’ টানতে না পারায় অতিকথনে সর্বনাশ হয়েছে তাদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির হিসাব-নিকাশ বড়ই কঠিন। নিজের উচ্চারণই একজন রাজনীতিবিদকে জিরো থেকে হিরো বানায়। আবার কথার কারণেই তাদের কেউ কেউ আকাশ থেকে মাটিতে ছিটকে পড়েন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশেষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমপি, মন্ত্রী, মেয়রদের কর্মকা- পর্যালোচনা করলে এমন চিত্র পাওয়া যায়। কথার ‘হিসাব’ না থাকায় হিরো থেকে রাতারাতি জিরোয় পরিণত হয়েছেন অনেকেই। খোয়াতে হয়েছে এমপি-মন্ত্রিত্ব, দলের পদ-পদবি, মেয়র পদও। পরবর্তীতে তাদের সামাল দিতে হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা।
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান সাম্প্রতিক সময়ে চরম আপত্তিকর, অশ্লীল মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমানকে অশালীন ও বর্ণবাদী কথা বলে সমালোচিত এই প্রতিমন্ত্রী এর আগেও এমন মন্তব্য করেছেন। একজন চিত্রনায়িকার সঙ্গে তার কথোপকথনের একটি অডিও ফাঁস হয়। সেখানে ওই নায়িকার উদেশে অশ্রাব্য কথা বলতে শোনা যায়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রী ও ছাত্রলীগ নেত্রীদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি তার পেশাব করার সময়ও নেই। এ নিয়ে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া কিংবা তার পদত্যাগের দাবিও ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদের ঝড় ও নিন্দার মুখে শেষ পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রীকে সরে যেতে বলা হলো। সোমবার প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন। ওইদিন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য সম্পাদক পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বুধবার সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকেও অব্যাহতি পান তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে বিষয়টি আলোচনা হতে পারে। ফলে এমপি পদও হারাচ্ছেন মুরাদ।
২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হজ, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাবলিগ জামাতকে নিয়ে কটূক্তি করে মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে তখনকার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। লতিফ সিদ্দিকীর অযাচিত মন্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটে ছাড়িয়ে পড়লে মাঠে নামে কয়েকটি ইসলামী দল। ওই বছরের ১২ অক্টোবর বিকালে তাকে মন্ত্রিপদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওইদিন রাতে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। নিজ জেলা টাঙ্গাইলসহ সারা দেশে মামলা হয় ডজনখানেক। জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। সর্বশেষ তাকে জেল হাজতেও যেতে হয়।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ উঠেছিল গত সেপ্টেম্বরে। ওই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে জাহাঙ্গীর অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ৩ অক্টোবর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয় কেন্দ্র থেকে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাকে ওই নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়। মেয়র জাহাঙ্গীর নোটিসের জবাব দেন। ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২৫ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যদিও বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর দাবি করেন, অডিও সুপার এডিট করা। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। জাহাঙ্গীর আলম স্কুল থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জেলার ছাত্রলীগ ও পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হন। এরপর গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে গাজীপুর সিটির মেয়র হন তিনি ২০১৮ সালে।
বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে প্রথমে দলীয় পদ থেকে ছিটকে পড়েন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী। পরে তাকে গ্রেফতারের দাবিতে নিজ এলাকায়ই বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ হয়। একপর্যায়ে তাকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় একাধিক মামলা। ১ ডিসেম্বর আব্বাস আলীকে ঢাকা থেকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। বর্তমানে তিনি পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। বিতর্কিত মন্তব্যের পর ইতিমধ্যে সরকারি ড্রেন দখল করে আব্বাস আলীর গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন।

Comments (0)
Add Comment