আমদানি নির্ভরতায় পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি : কাল থেকে কম দামে বিক্রি করবে টিসিবি

সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ৩৫ টাকা

 উৎপাদনের চেয়ে আমদানি হয়েছে অনেক গুণ

স্টাফ রিপোর্টার: পেঁয়াজ নিয়ে ক্রেতাদের গত বছরের দগদগে ক্ষত এখনো শুকায়নি। এরমধ্যেই আবার বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। শাকসবজির বাড়তি দর, কাঁচামরিচের অত্যধিক দাম, সেইসঙ্গে পেঁয়াজের বাড়তি ঝাঁজে রীতিমতো ভোগান্তিতে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

কিন্তু হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কেন? এই প্রশ্ন এখন ক্রেতাদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে বেঙ্গালুরে নতুন পেঁয়াজের আবাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। দেশে সেপ্টেম্বরের এ সময়ে ভারত থেকে যে পেঁয়াজটা আমদানি করা হয়, তা বেঙ্গালুরের এই নতুন পেঁয়াজ। নতুন পেঁয়াজ হওয়ায় দাম কম থাকে। দেশের বাজারেও কম দামে এ পেঁয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু বেঙ্গালুরের এ পেঁয়াজের আবাদ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভারতের অন্য এলাকার পুরোনো পেঁয়াজ এখন আমদানি করা হচ্ছে। আর পুরোনো পেঁয়াজের দাম বেশি। দেশের পেঁয়াজের বাজারে এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমরা পেঁয়াজে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছি। আর এর সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ীরা। কারণ এখনো দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। ভারতের একটা অঞ্চলের আবাদ নষ্ট হলে এত দ্রুত পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৩০/৩৫ টাকা বাড়বে কেন? এটা কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না! সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো তা থেকে কর্তৃপক্ষ কোনো শিক্ষাই নেয়নি, নিলে আর এ অবস্থা হতো না। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়। যা এক সপ্তাহ আগেও যথাক্রমে ২৫ থেকে ৩০ টাকা ও ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ছিলো।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন। আর এই চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করে মেটানো হয়। কারণ, গত কয়েক বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়লেও আমদানি বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ১৭ থেকে ১৮ লাখ মেট্রিক টনে স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু এই সময়ে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে অনেক বেশি।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় ৭.৩৫ লাখ মেট্রিক টন। ১০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয় ১৭.৩৮ লাখ টন। এ হিসাবে ১০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে ১৩৬ শতাংশ বা ২.৩৬ গুণ। এ সময়ে হেক্টরপ্রতি ফলন ৬.৮১ টন থেকে বেড়ে ৯.৭৬ টন হয়েছে। মূলত নতুন জাত ও উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এ ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পেঁয়াজের আমদানি।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১.৩৪৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০.৬৪৩ লাখ টন। এ হিসাবে ১০ বছরে উত্পাদন বেড়েছে ২.৩৬ গুণ আর আমদানি বেড়েছে ৭.৯ গুণ। আর এ আমদানি-নির্ভরতা বাড়ার কারণেই কোনো কারণে আমদানিতে ঘাটতি হলেই দেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি। গত বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে দেশে পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পেঁয়াজ নিয়ে এ সমস্যা দূর করতে হলে আমদানি-নির্ভরতা কমাতে হবে। বাড়াতে হবে পেঁয়াজের উৎপাদন।

পেঁয়াজ আমদানিকারক মোবারক হোসেন বলেন, ভারত থেকে বাড়তি দরে পেঁয়াজ আমদানির ফলেই দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের বেঙ্গানুর থেকে যে নতুন পেঁয়াজ আমদানি করা হতো, এবার অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে সেই পেঁয়াজের আবাদ মার খাওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পেঁয়াজের দামটা একটু বেড়েছে। শুধু দেশে না, ভারতেও দাম বেড়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। ইতোমধ্যে টিসিবির মাধ্যমে টার্কি থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য টেন্ডারও করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বাণিজ্যসচিবের কথা হয়েছে। আমরা পেঁয়াজ আমদানির সবগুলো পথ খুলে দিতে চাই। এ বছর আমাদের পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজের যে ঘাটতি রয়েছে তা আমদানি করে মেটানো হবে। পেঁয়াজ নিয়ে কোনো কারসাজি হচ্ছে কিনা, তা দেখতে বেশ কয়েকটি মনিটরিং টিম কাজ করছে।’

এদিকে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগামীকাল রোববার থেকে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করবে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

 

Comments (0)
Add Comment