ইভিএম নিয়ে নতুন জটিলতায় ইসি : সিদ্ধান্ত দিয়ে যায়নি হুদা কমিশন

ভোটগ্রহণে ধীরগতি কাটাতে আঙুলের ছাপের পরিবর্তে এনআইডি ব্যবহারের প্রস্তাব
স্টাফ রিপোর্টার: ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে নতুন জটিলতায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। কয়েকটি কারণে এ জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ইভিএম সংরক্ষণের জন্য গুদাম ভাড়ার প্রস্তাবে বিদায়ি কমিশনের মতপার্থক্য এবং ৩৮ জেলায় সরকার নির্ধারিত হারে গুদাম না পাওয়া। ভোটগ্রহণে ধীরগতি কাটাতে বিকল্প প্রস্তাব এবং বিদ্যমান ইভিএমের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে করণীয় নির্ধারণ। এসব জটিলতা নিরসনের বিষয়টি নতুন কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে ইসি সচিবালয়। ওই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতসংখ্যক আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে-সেই পরিকল্পনা গ্রহণ। ইসি সচিবালয় ও মাঠ পর্যায় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশিষ্টরা জানান, বিদ্যমান ইভিএমে ভোট কারচুপির বড় ধরনের প্রমাণ এখনো মেলেনি। তবে নির্বাচনে ভোটগ্রহণে ধীরগতিসহ ভোগান্তির অনেক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ইভিএম ব্যবহারের কারণে নির্বাচনি ব্যয় বৃদ্ধি, কাগজের ব্যালটের তুলনায় এ মেশিন ব্যবহারে বাড়তি জনবল নিয়োগের মতো সমস্যা রয়েছে। এসব জটিলতা নিরসনে কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে যায়নি কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বে বিদায়ি নির্বাচন কমিশন।
ইভিএমের জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব ও ইভিএম কারিগরি কমিটির সভাপতি অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, এই মুহূর্তে ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে বড় জটিলতা হচ্ছে সংরক্ষণের বিষয়টি। সংরক্ষণের মতো স্থান না থাকায় দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে ৮৫ হাজারের বেশি এখনো বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) পড়ে আছে। সেগুলো আনতে পারছি না। ইভিএম কেনার সময়ে সংরক্ষণের বিষয়টি চিন্তা করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ভোটগ্রহণে ধীরগতির বিষয়ে ভোটার এডুকেশন বাড়ালে তা ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে হলে সাড়ে চার লাখ মেশিন দরকার। আমাদের কাছে আছে দেড় লাখ। বিদ্যমান প্রকল্পে আর ইভিএম কেনার কোনো টাকা ধরা নেই। নতুন করে ইভিএম কিনতে হলে আরেকটি প্রকল্প নিতে হবে। সেটি ইসির নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের বিষয়।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প নেয় কেএম নূরুল হুদা কমিশন। ২০১৮ সালের জুনে নেয়া ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। এছাড়া প্রকল্পের বাইরে আরও দুই হাজার ৫৩৫টি ইভিএম কিনেছিল ইসি।
সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় অনেক জেলায় ইভিএমের সরঞ্জাম ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। নাম গোপন রাখার শর্তে তারা জানান, সংরক্ষণের স্থান না থাকায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সার্ভার স্টেশনগুলোতে একটার ওপর আরেকটা ইভিএম স্তূপ রাখা হয়েছে। এতে ভারের চাপে অনেক ইভিএমের মনিটর ও ব্যালট ইউনিট নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক উপজেলায় সংরক্ষিত ইভিএম দিয়ে ভোটগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ইভিএম নিয়ে সেখানে ভোট নেয়া হয়েছে। এছাড়া কোথাও কোথাও কন্ট্রোল ইউনিটে সঠিক সময় প্রদর্শন করছে না। এ কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে ভোটগ্রহণ শুরু ও শেষ হয়। তারা বলেন, ইভিএম কিনেই মাঠ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এসব মেশিন সংরক্ষণের মতো জনবল, পরিবহণ ব্যবস্থা ও অর্থের সংস্থান করা হয়নি। এ কারণে অযতেœ নষ্ট হচ্ছে এসব মেশিন।
আরও জানা গেছে, বিদায়ি কমিশনের সর্বশেষ ৯৩তম সভায় ইভিএম প্রকল্প থেকেই এ সংক্রান্ত তিন ধরনের জটিলতার তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই সভায় জানানো হয়, ইভিএম সরঞ্জাম যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ না করার ফলে অডিট কার্ড ব্লক হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অডিট ও পোলিং কার্ড নষ্ট হয়ে গেছে। কখনো হারিয়ে গেছে। এসব সমস্যার কারণে সঠিক সময়ে ভোটগ্রহণ পরিচালনা করা এবং ফলাফল প্রস্তুত ও মুদ্রণ করতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। যদিও ওইসব জটিলতার প্রেক্ষিতে কারিগরি কমিটির সভাও করেছে নির্বাচন কমিশন।
সংরক্ষণ জটিলতা : জানা গেছে, ইভিএম নিয়ে সর্বশেষ জটিলতা তৈরি করেছে সংরক্ষণ স্থান নির্ধারণ নিয়ে। কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিদায় মুহূর্তে ২৬টি জেলায় ইভিএম সংরক্ষণ স্থান ভাড়া নেয়ার বিষয়ে আর্থিক অনুমোদন চেয়েছিল ইসি সচিবালয়। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৬টি জেলায় গুদাম পাওয়া গেছে, যেগুলোর ভাড়া গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হারের সমান অথবা কম। জেলাভেদে তিন হাজার বর্গফুট থেকে নয় হাজার ৬৬৮ বর্গফুট আয়তনের গুদাম ভাড়ার জন্য চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে এক কোটি তিন লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। তবে এ টাকা বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে দুজন নির্বাচন কমিশনার ভিন্ন মত দেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী তার মতামতে বলেন, ইভিএম ভাড়ার জন্য যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা সম্ভব। অপরদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম তার মতামতে কারিগরি দিক খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যেসব স্থানে সংরক্ষণ করা হবে তা ইভিএম’র জন্য উপযোগী কিনা, বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে কিনা এসব দেখতে কারিগরি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ওই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে টাকা অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। আরও জানা গেছে, ইসি সচিবালয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে এই দুজন কমিশনারের ভিন্নমতের কারণে সারা দেশের গুদাম ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি ঝুলে গেছে। ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিবছর ৬৪ জেলায় গুদাম ভাড়া বাবদ প্রায় ৫ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে।
সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াই ইভিএম কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে এ প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল মো. কামাল উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের ডিপিপিতে আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা সার্ভার স্টেশনে ইভিএম সংরক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। বাস্তবে স্থান সংকটের কারণে সেখানে ইভিএম রাখা যাচ্ছে না। আমরা প্রতিটি জেলায় ৫-৭ হাজার বর্গফুট আকারের গুদাম ভাড়া নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি।
জানা গেছে, ইভিএম সংরক্ষণের জন্য দেশের ৬৪ জেলায় গুদাম খুঁজে বের করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রতিটি জেলায় দুই হাজার ৫০০ ইভিএম রাখতে পাঁচ থেকে সাত হাজার বর্গফুট আকারের গুদাম খুঁজতে বলা হয়। দীর্ঘদিন ধরে খুঁজেও সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় মাত্র ২৬টি জেলায় ইভিএম সংরক্ষণের গুদাম খুঁজে পেয়েছেন ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। বাকি ৩৮ জেলায় গুদাম পাচ্ছেন না ইসির কর্মকর্তারা। আরও জানা গেছে, চট্টগ্রামে গুদামের জন্য প্রতি বর্গফুট ১২০ টাকা দর চেয়েছেন ভাড়া দেওয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক। স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা গুদাম মালিকের সঙ্গে আলোচনা ভিত্তিতে সেটি কমিয়ে প্রতি বর্গফুট ৮০-৮৫ টাকা নির্ধারণ করেছেন। ঢাকার সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তার এলাকায় প্রতি বর্গফুটের ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা হারে। সিরাজগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ইসি সচিবালয়কে জানিয়েছেন, তার জেলায় ৬০০ মিটার আকারের একটি গুদাম পাওয়া গেছে। যেটিতে প্রতি বর্গফুট ২১ টাকা হিসাবে মাসে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। এর সঙ্গে পানি, বিদ্যুৎ, ভ্যাট ও উৎসে কর যুক্ত হবে। অপরদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তার জেলায় প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা দরে ৯০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, প্রত্যেক জেলার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ভাড়ার হার রয়েছে। ইসি ওই হারের বাইরে যেতে রাজি নয়। এ কারণে অনেক জেলায় গুদাম পাওয়া যাচ্ছে না।
নির্বাচনের আগে মেয়াদ শেষ হচ্ছে ইভিএম প্রকল্পের : প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএমটিএফ থেকে দেড় লাখ ইভিএম সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে এসব মেশিনের বয়স সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসব ইভিএমের সাপোর্ট চুক্তি রয়েছে পাঁচ বছরের। আর ওয়ারেন্টি ছিল এক বছরের। এ হিসাবে সাপোর্ট চুক্তির মেয়াদ আছে আর মাত্র দেড় বছর। ওই সময়ের পর ইভিএম পরিচালনার বিষয়টি পুরোপুরি ইসির ওপর নির্ভর করবে। বিদায়ি কমিশন এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত রেখে যায়নি। এ বিষয়টিও ইসির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ইভিএমের আয়ুষ্কালের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। বিএমটিএফ’র সঙ্গে সাপোর্ট চুক্তি রয়েছে পাঁচ বছরের। এরপরও এসব মেশিন চলবে না তা নয়। এ সময়ের মধ্যে নতুন টেকনোলজি আসলে বিদ্যমান ইভিএম তা সাপোর্ট করবে না। সেক্ষেত্রে নতুন ইভিএম কিনতে হবে।
আঙুলের ছাপের বদলে এনআইডি ব্যবহার : জানা গেছে, বর্তমানে আঙুলের ছাপ দিয়ে ইভিএমে ভোটার শনাক্ত করা হয়। এতে ভোটগ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ ওঠে। বিদায়ি কমিশনের সর্বশেষ ৯৩তম সভায় এর কারণ তুলে ধরেন প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল মো. কামাল উদ্দিন। ওই সভার কার্যপত্রে তিনি প্রস্তাব করেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার নম্বর- যে কোনো একটি মাধ্যমে ভোটার শনাক্ত করলে সময় কম লাগবে। ওই সভায় তিনি ইভিএম ব্যবহার সংক্রান্ত কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। তিনি জানান, ইভিএম সরঞ্জাম যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ না করার ফলে অডিট কার্ড ব্লক হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অডিট ও পোলিং কার্ড নষ্ট হয়ে গেছে। কখনো হারিয়ে গেছে। এসব সমস্যার কারণে সঠিক সময়ে ভোটগ্রহণ পরিচালনা করা এবং ফলাফল প্রস্তুত ও মুদ্রণ করতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তিনি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ইভিএম সরঞ্জামাদির যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরামর্শ দেন।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব সমস্যার কারণে ইভিএম নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। তারা মনে করেন, মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন অফিসগুলোতে লজিস্টিক সাপোর্ট না দেয়া হলে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ মেশিনের যতেœর বিষয়ে আন্তরিক না হলে এসব মেশিন স্থায়িত্ব পাবে না।

Comments (0)
Add Comment