কোটচাঁদপুরের রেজাউল দালাল অবশেষে যশোরে গ্রেফতার

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চলের অস্ত্র, স্বর্ণ, মাদক সিন্ডিকেটের গডফাদার কুখ্যাত সন্ত্রাসী রেজাউল পাঠান ওরফে রেজাউল দালালকে অবশেষে যশোহরের শার্শা থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পরবর্তীতে তাকে ওই রাতেই কোটচাঁদপুর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলে গত শনিবার দুপুরের পর রেজাউল দালালকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। অদৃশ্য কারণে থানা পুলিশ অনেকটা গোপনে এ কাজগুলো সারেন। রেজাউল দালালের বিরুদ্ধে কোটচাঁদপুর থানাসহ বিভিন্ন থানায় ৭-৮টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে অস্ত্র, ডাকাতি, দস্যুতা, মাদক ও চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। এর আগে রেজাউল দালালকে ধরতে পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি দফায় দফায় বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়। সে দীর্ঘদিন পলাতক ছিলো।
যশোহর শার্শা থানার কর্মকর্তা ইনচার্জ বদরুল আলম খান জানান, গত শুক্রবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে থানার বাগআচড়া এলাকা থেকে সন্ত্রাসী রেজাউল দালালকে গ্রেফতার করা হয়। ওই রাতেই তাকে কোটচাঁদপুর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছি। সে ২/৩ ধরে এ এলাকায় বাসা ভাড়া করে বসবাস করে আসছিলো। কোটচাঁদপুর থানা কর্মকর্তা ইনচার্জ মাহাবুবুল আলম বলেন, সন্ত্রাসী রেজাউলকে শার্শা থানা থেকে আনার পর তাকে আদালতে সোপার্দ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী মহেশপুর থানা কর্মকর্তা ইনচার্জ মোরশেদ খান বলেন, রেজাউলের বিরুদ্ধে আমার থানায় ১টি ডাকাতি ও ২টি দস্যুতার মামলা রয়েছে।
কে এই রেজাউল দালাল?
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর শহরের আদর্শপাড়ার মৃত মমিন পাঠানের ছেলে রেজাউল পাঠান। তিনি ছিলেন ভবঘুরে। অভাব অনটনের সংসার। টাকা রোজগারের জন্য তার মাকে চলে যেতে হয় দেশের বাইরে। সেখান থেকে মা যৎসামান্য যা পাঠাতেন, তাই নিয়ে কষ্টের মধ্যে চলতো তার দিন। এলাকার মানুষের ভাষ্যমতে, মাঝে-মধ্যেই দেখা যেতো গ্রামাঞ্চলে থানার কোনো কর্মকর্তা মামলার তদন্ত সংক্রান্ত কাজে গেলে রেজাউল পাঠান তার ৭০ সিসির মোটরসাইকেলে তাদের বহন করতেন। বিনিময়ে কিছু টাকা পেতেন। এভাবে পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার একপর্যায়ে তিনি সোর্স হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। চোরাচালানিদের আনা ভারতীয় মাদক, চিনি, লবণ, শাড়ি-কাপড় থেকে শুরু করে আসামি ধরিয়ে দেয়ার কাজে নেমে পড়েন তিনি। বছর দুয়েকের মধ্যে তিনি পুলিশের আস্থাভাজন সোর্স হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এলাকায় রেজাউল পাঠান থেকে পরিচিতি পান রেজাউল দালাল হিসেবে। পুলিশের আস্তাভাজন হওয়ার সুযোগে সুচতুর রেজাউল সোর্সের কাজের পাশাপাশি নিজেই মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পাশাপাশি পুলিশের অন্য সোর্সদের মাদক দিয়ে পুলিশে হাতে ধরিয়ে দেয়াসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করতে থাকেন। পরে নিজেই আবার ওই সোর্সদের জামিনে ছাড়িয়ে এনে নিজের পক্ষে ভেড়াতেন। ফলে অন্য সোর্সরা ঝামেলা এড়াতে রেজাউলের পক্ষে ছাড়া পুলিশের পক্ষে কাজ করতে না চাওয়ায় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সোর্স হিসাবে রেজাউলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তার প্রকাশ্য উপস্থিতি রেজাউলের ক্ষমতার জানান দেয়। হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। মাদক সিন্ডিকেটের পাশাপাশি যোগ করেন স্বর্ণ ও অস্ত্র চোরাচালান ব্যবসা। অভিযোগ রয়েছে, রাতের বেলায় অপরিচিত লোককে পুলিশের পোশাক পরিয়ে কোটচাঁদপুর-জীবননগর মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়কের নির্জন স্থানে গাড়ি থামিয়ে রেজাউল তল্লাশি করতো। এ ধরনের গুরুতর অপরাধ প্রচার হয়ে পড়ায় র‌্যাব-পুলিশ তাকে গ্রেফতারের জন্য বেশ কয়েক বার অভিযান চালায়। কিন্তু রেজাউল দালালকে ধরা সম্ভব হয়নি। পরে বিশেষ কায়দায় কিছু মাদক ও স্বর্ণের চালান ধরিয়ে দিয়ে আবারো প্রশাসনিক কর্তাদের আস্তাভাজন হয়ে ওঠে তিনি। সেসময় কয়েকটি স্বর্ণের বড় ধরনের চালান ধরিয়ে দিয়ে রেজাউল দালালেরও রাতারাতি আর্থিক অবস্থা পাল্টিয়ে যায়। একাধিকসূত্র জানায় স্বর্ণ চোরাচালানীদের চালান বার বার ধরা পড়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তারাও সে সময় রেজাউল দালালের স্বরণাপন্ন হয়। পরে রেজাউল দালাল তাদেরকে নিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ ও অস্ত্র চোরাচালানের শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তারপর থেকে সে ধরনের আর কোনো স্বর্ণের চালান ধরা পড়েনি। রেজাউল দালাল চোরাচালানসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কাজে সফল হওয়ায় কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান খুবই অল্প সময়ে। সে সময়ে তিনি দুই তলা বাড়ি তৈরি করণে তাতে করেন শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। করেন বাড়িতে আধুনিক বিলাস-ব্যসনের সকল ব্যবস্থাও। বাড়ির আশপাশসহ ৪শ’ গজ দূর পর্যন্ত ১ ডর্জন সিসি টিভি ক্যামেরা বসান। নিজ এলাকাসহ শ্বশুর বাড়িতে কেনেন কয়েক বিঘা জমি। এর বাইরেও নামে-বেনামে অনেক টাকাও সম্পদের মালিক তিনি। এরপর কপর্দকশূন্য রেজাউল দালাল স্বপ্ন দেখেন কোটচাঁদপুর পৌরসভার কাউন্সিলর হবার। গত পৌর নির্বাচনে পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে দাঁড়ান তিনি। নিজ এলাকা ও বাইরের সন্ত্রাসী এনে এলাকার সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নির্বাচিত হয়ে যান। সেই ভোটে ৪০-৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কাউন্সিলর হওয়ার পর তার দৌঁরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার মানুষ বলছেন, বিচারের নামে বাড়িতে আটকে রেখে বহু লোকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রেজাউল। এছাড়া তার পোষ্য বাহিনী দিয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে এলাকায় রেজাউল দালাল আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এলাকার সাধারণ মানুষ। রেজাউল দালাল ওরফে রেজাউল পাঠান কোটচাঁদপুর সাধারণ মানুষের কাছে একটি ভীতিকর নাম হয়ে ওঠে। এদিকে আগের মতোই চালিয়ে যান তিনি স্বর্ণ ও অস্ত্র ব্যবসা। রেজাউল দালালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে গ্রেফতারের দাবিতে কোটচাঁদপুর শহরে মানববন্ধন, মিছিলও করে এলাকাবাসী। পরে এলাকাবাসীর পক্ষে রেজাউল দালালের গ্রেফতারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন কোটচাঁদপুর পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুজ্জামান সেলিম। অবশেষে ২০১৫ সালের ২৬ জুন রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রেজাউল দালালের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। এসময় ১টি বিদেশী পিস্তল, ৪০ রাউন্ড গুলি, প্রচুর পরিমাণে ফেনসিডিল, ইয়াবা, চাইনিজ কুড়াল, হাঁসুয়া, ইয়ারগানের বাট, লক্ষাধিক টাকা, পুলিশের পোশাক ও হ্যান্ডকাপ এবং বিভিন্ন অধৈক জিনিসসহ রেজাউল দালাল ও তার ২ সহযোগীকে আটক করে। বছর না ঘুরতেই জামিনে এলে র‌্যাব আবারো রেজাউল দালালকে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ আটক করে পুনরায় জেলে পাঠায়। পরবর্তীতে জেল থেকে বের হয়ে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে মহেশপুরের পুরন্দপুর নামকস্থানে তার বাহিনী নিয়ে ডাকাতি করে। তারপর থেকে পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি আরও তৎপর হলে পলাতক ছিলেন রেজাউল দালাল। অথচ দীর্ঘ ২ বছর পৌরসভায় অনুপস্থিত থেকেও তার কাউন্সিলর পদটি আছে বহাল তবিয়তে।

Comments (0)
Add Comment