চুয়াডাঙ্গার ঝাঝরি গ্রামে কন্যাশিশু জন্ম দেয়ায় স্বামীগৃহ থেকে বিতাড়িত শিউলি

সাড়ে ৪ বছর ধরে পিত্রালয়ে কাটাচ্ছে মানবতার জীবনযাপন

বেগমপুর প্রতিনিধি: ‘হাজার কণা দুঃখদানা দুঃখ খোঁটে চড়াইটি, মেয়ে যেনো মানুষই না অবলা ওই ঘাস মাটি’। কবির ভাষায় আধুনিক যুগে এসে নারীরা আজও অবহেলিত। তার ওপর আমাদের সমাজে মেয়েদের কন্যাসন্তান জন্ম দেয়াকে ভালোভাবে নেয়নি শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ছেলে সন্তানকে বংশের প্রদীপ হিসেবে দেখে তারা। সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এটাতো সৃষ্টিকর্তার হাতে। তারপরও অনেক ছেলের মা-বাবা এটা মানতে নারাজ। কণ্যা সন্তান হলেই অপরাধের চোখে দেখা হয় ছেলের বৌকে। কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ি যখন একজন নারীকে অলক্ষ্মীর চোখে দেখে তখন হাসি মুখে স্বামী গৃহে যাওয়া মেয়েটার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। তখন পরিস্কার আকাশে দেখা মেলে কালো মেঘের ঘনঘটা। সংসার জীবনে যেনো আর আলোর দেখা মিলতেই চায় না কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া মেয়েটার ভাগ্যে। তবে সবক্ষেত্রে যে এমনটা হয় তা কিন্তু না। অনেক পরিবারে সন্তান ছেলে হোক আর মেয়েই হোক না কেন তাদেরকে সম্পদ হিসেবে দেখে আদর যতেœ বড় করে তোলা হয়। দু’টি কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে ১১ বছরের বিবাহিত জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গার ঝাঝরি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যের মেয়ে শিউলি আক্তারের। সাড়ে ৪ বছর ধরে মেয়ে ফেরদৌসি আর মাওয়াকে বুকে নিয়ে পিত্রালয়ে মানবতের জীবন যাপন করছেন তিনি। স্বামীর বাড়ির লোকজন একটু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করলেই হয়তো সবকিছু সহজেই মানিয়ে নেয়া সম্ভব হতো। তা আর ভাগ্যে জোটেনি শিউলির।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের ঝাঝরি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল নুর মোহাম্মদের মেয়ে বিএ পাস করা শিউলি আক্তারের গত ২০০৯ সালের ৭ জুলাই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ভৈরবা বাজার পাড়ার রেজাউল ইসলামের ছেলে সাব্বির হোসেনের সাথে। বিয়ের পর দাম্পত্য জীবনে দু’টি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন শিউলি। বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসি (১০) ও জান্নাতুল মাওয়া (৫)। বিয়ের পরেই স্বামী নামক শাসনকর্তা শিউলির পরিবারের নিকট বিভিন্ন অজুহাতে অর্থ হাতিয়ে নিতে থাকেন। আর একমাত্র মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে বাবা নুর মোহাম্মদ অবসর ফা-ের টাকা থেকে বেশকিছু অর্থও দিয়ে ফেলেন জামাই সাব্বিরের হাতে।
শিউলি অভিযোগ করে বলেন, প্রথম মেয়ে হবার পর খুব একটা খুশি থাকে না সাব্বির। তাই পরের বার আগে ভাগেই শাসিয়ে রাখে এবার যেনো ছেলে হয়। সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এটা যে সৃষ্টিকর্তার হাতে এটা একেবারেই বুঝতেই চাচ্ছিলো না সাব্বির ও তার মা-বাবা। দ্বিতীয় সন্তান হবার পর থেকে আমার জীবনে নেমে আসে মানসিক নির্যাতন। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে কোনোরকম জীবন বাঁচিয়ে চলে আসি বাপের বাড়িতে। সেই থেকে সাড়ে ৪ বছর বাবার বাড়িতেই মেয়ে দুটিকে বুকে নিয়ে মানবতের জীবন যাপন করছি। শুধু কি তাই সুখের অলিক স্বপ্ন দেখিয়ে আমার সোনালী ব্যাংকের চাকরি থেকে চাকরীচ্যুত পর্যন্ত করিয়েছে। শিউলির মা শাহার বানু বলেন, মেয়ের সুখের জন্য মা হিসেবে যতটুকু করার দরকার করেছি। তারপরও ১১ বছর ধরে ছেলে পক্ষের লোকজনের মন যোগাতে পারিনি। স্বামী ২০০৮ সালে পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। সামান্য কিছু পেনশন পায়। তাতে করে নিজেদেরই ঠিক মতো চলে না। তার ওপর ৩টি মুখে প্রতিদিন আহার তুলে দিতে হয়। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় আমার মেয়ে বড়ই অপরাধ করে ফেলেছে। যার কারণে তার আজ এ অবস্থা। এদিকে নারীর বিচার না পাওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে যে দিকটি সব থেকে উদ্বেগজনক তা হলো নারীর প্রতি বৈষম্য ও অবজ্ঞামূলক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। দেশের নানাক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটলেও এই মানসিকতা সমাজের বিভিন্ন পরিবারে এখনও ভয়ানক মাত্রায় রয়ে গেছে। নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য আর অপমান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির হয়ে গেছে। তেমনই বৈষম্যের শিকার উচ্চশিক্ষিত শিউলি আক্তার। তাই বিষয়টির প্রতি চুয়াডাঙ্গা মানবতার পুলিশ সুপারের সুদৃষ্টি কামনা করেছে শিউলি ও তার পরিবারের লোকজন।

Comments (0)
Add Comment