জটিলতা বাড়ছেই জাতীয় পার্টিতে

স্টাফ রিপোর্টার: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে জটিলতা তীব্র হচ্ছে। নির্বাচনে ভরাডুবি, দলীয় ও নির্বাচনি ফান্ড কুক্ষিগত করে রাখা, শেরীফা কাদেরের আসনের বিনিময়ে পার্টির সিনিয়র নেতাদের আসন সমঝোতায় বাদ দেয়া, নির্বাচনে সহযোগিতা না করাসহ নানা অভিযোগে নির্বাচনে অংশ নেয়া পার্টির অনেক প্রার্থী দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবির জন্য চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে দায়ী করেন। রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গতকাল দিনব্যাপী বিশেষ সভায় নির্বাচনে অংশ নেয়া ৩০ জন বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত ছিলেন ১২২ জন। এ সভায় দলের নেতা-কর্মী অংশ না নেয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৪ থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে উদ্দেশ করে বলেন, নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিল টাকাওয়ালা। আপনারা ২৬ জন সমঝোতা করেছেন। সিটও পেয়েছেন, অর্থও পেয়েছেন। ১৭ তারিখের আগে যখন দেখলেন নিজের বউয়ের (শেরীফা কাদের) আসন কনফার্ম নয়, তখন বললেন নির্বাচনে যাব কি না ঠিক নেই। আর যখন নিজ স্ত্রীর সমঝোতার মনোনয়ন কনফার্ম হলো, তখন বললেন নির্বাচনে যাব। শুধু নিজ স্ত্রীর জন্য পার্টির হেভিওয়েট নেতাদের রাজনৈতিকভাবে জবাই করলেন জি এম কাদের। একটু বুকও কাঁপল না আপনার! আপনি জি এম কাদের বললেন, ভিক্ষার সিট নেব না, ভিক্ষা তো ঠিকই নিলেন।
সারা দেশে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই এলাকায় সম্মানিত। কাউকে সম্মান না করেন, অসম্মান করার অধিকার আপনাদের নেই। আপনাদের ভেলকিবাজি নেতা-কর্মীরা বুঝে গেছে। আজকে যদি আঘাতপ্রাপ্ত ও বহিষ্কৃতরা এক হয়ে যায়, তাহলে আপনার (জি এম কাদের) টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। জাপা মহাসচিব প্রার্থীদের টাকা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জানিয়ে সেন্টু বলেন, আমি তাকে বললাম যাই পান কিছু কিছু দেন। মহাসচিব বললেন, টাকা পেয়েছি, কিন্তু অল্প। উনি কী করলেন, চেয়ারম্যানের স্ত্রীর কাছে একটা অ্যামাউন্ট দিয়ে চলে গেলেন নির্বাচনি এলাকায়। কোনো প্রার্থীকে তিনি কিছু বলেননি। মহাসচিব বললেন, সেন্টু! এটা শেরীফা কাদের দেখবেন।
পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজি সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেন, জি এম কাদেরকে সাচ্চা ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জানতাম। এর আগেও তিনি যখন দলের মাঝে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন তখনো আমি বলেছিলাম, কেউ আপনার পাশে না থাকলেও আমি থাকব। আজকে জি এম কাদের যদি নির্বাচনে না যেতেন, তাহলে জাতির কাছে তিনি হিরো হতেন। আমাদের হতো আগামীর বাংলাদেশ। আমরা চাই না দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। আমি যাই বলেছি, দলের পক্ষে বলেছি। আজকে হয়তো আমাকে, কাজী ফিরোজ, বাবলাকে বহিষ্কার করতে পারবেন, সে ক্ষমতা আপনার (জি এম কাদের) আছে। কিন্তু আরেকটি মিলন, কাজী ফিরোজ বা বাবলা জন্ম দিতে পারবেন না। প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, আমরা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এ সভা করছি না। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আমরা জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে চাই। কিন্তু কিছু লোক চেয়ারম্যানকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। যাদের কোনো নেতা-কর্মী নেই। তারা নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখতে পার্টির মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে।
সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেটের প্রার্থী ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, আপনি গণতন্ত্র শিখিয়েছেন, আপনার মধ্যে গণতন্ত্র নেই। আপনি স্ত্রীর জন্য ফিরোজ, বাবলা, খোকা, পীর ফজলু, আতিক, ভাষানীসহ নয়টি সিট কোরবানি দিয়েছেন। সমঝোতার আসনের জন্য চেয়ারম্যান নিজের স্ত্রী, নাতি আর মেয়ের ভাসুরের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছেন। তিনি বলেন, আপনার স্ত্রী শুধু আপনাকে রান্না করে ভাত খাওয়ান, দলে তার কী অবদান বলেন? আমাদের টাকা আপনারা ভাগ বাটোয়ারা করেছেন। আপনাদের জবাব দিতে হবে। নোয়াখালীর ফজলে এলাহী সোহাগ বলেন, নির্বাচনের সময় মহাসচিবকে শতাধিক বার ফোন দিয়েছি, কিন্তু তিনি ধরেননি। তিনি একজন প্রতারক ও বাটপার। তিনি সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে আমাদের প্রার্থীদের না দিয়ে নিজের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান আপনি হাজির নাজির করে ওয়াদা দিয়েছিলেন, এককভাবে নির্বাচন করবেন, নির্বাচনে আমাদের পাশে থাকবেন, কিন্তু আপনি কোনো কথা রাখেননি। আমাদের পথে নামিয়ে দিয়েছেন। আপনি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে নীতিকথা বলতেন, চেয়ারম্যান হওয়ার পর পরিবর্তন হয়ে গেছেন। প্রেসিডিয়াম সদস্য কেরানির মতো ফাইল নিয়ে আপনার পেছনে ঘুরেন। তিনি দলের প্রেসিডিয়াম কী করে হয়।
সিরাজগঞ্জের প্রার্থী ফজলুল হক নুরু বলেন, মিটিংয়ে এলে বহিষ্কারের হুমকি দেয়া হয়েছে। আমি এসেছি, দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে। বহিষ্কার করবেন, করেন। আগে বাবলা, খোকাদের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, আগেও ২ লাখ টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে এনে লাঙ্গল দেওয়া হয়। মনোনয়ন বাণিজ্য করলেন। দলকে এভাবে শেষ করে দেবেন না।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের প্রার্থী মোক্তার হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে দল থেকে বলা হলো নির্বাচন কর। তুমি কিছু খরচ কর, আর বাকিটা দল দেবে। সে মোতাবেক আমি দোকান বিক্রি করে প্রথম কয়েকদিন প্রচারণা চালিয়েছি। পরে জি এম কাদের ও চুন্নুকে কল দিলে তারা আর রিসিভ করেননি। পরে ঢাকায় এসে দেখা করতে চাইলাম, তাও মানা করে দিয়েছেন। কারণ, তাদের ভিতর ভয়, তারা যে টাকা আত্মসাৎ করেছে, কী জবাব দেবে? ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেল বলেন, আমরা সব কিছু দিয়ে নির্বাচন করেছি। একটু খবর নেয়নি, ১০টা টাকা দেয়নি। আর কতো মাথা বিক্রি করবেন। নির্বাচন এলে আর মাথা বিক্রি করবেন না।
আবদুল হামিদ খান ভাষানী বলেন, আমার সমঝোতার আসন বহিরাগতকে দিয়েছেন। চেয়ারম্যান ও মহাসচিব চার আন্ডা (ডিম) বেষ্টিত হয়ে পড়েছেন। এই আন্ডামুক্ত না হলে দল ধ্বংস হয়ে যাবে। জাপার কেন্দ্রীয় সদস্য সাহিন আরা চৌধুরী রিমা বলেন, শেরীফা কাদেরের কী অবদান আছে জাতীয় পার্টিতে! তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে হবে এমপি বানাতে হবে! শুধু শেরীফা কাদেরের জন্য পার্টির বরেণ্য ব্যক্তিদের জবাই করেছেন জি এম কাদের।