ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’ আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার: চলে গেলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত কিংবদন্তি নায়ক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ফারুকের বয়স হয়েছিলো ৭৪ বছর। কিংবদন্তি এ নায়কের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে। সহকর্মীরাও শোক প্রকাশ করেছেন। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন নায়ক ফারুক। উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। পুরনো বেশকিছু শারীরিক জটিলতাও ছিলো। সবশেষ ২০২১ সালের ৪ঠা মার্চ নিয়মিত চেকআপের জন্য সিঙ্গাপুরে যান এই অভিনেতা। কিংবদন্তি এই অভিনেতার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তথ্যমন্ত্রী ডক্টর হাছান মাহমুদ। সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তার অভিনীত চলচ্চিত্র দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার অবদান দেশের মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ রাষ্ট্রপতি মরহুম আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। পাশাপাশি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে ফারুকের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডক্টর হাছান মাহমুদ।

এদিকে ফারুকের স্বপ্ন ছিলো সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি জনগণের সেবা করে যাওয়ার তেমন সুযোগ আর পেলেন না।

নায়ক ফারুকের মৃত্যুতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতিসহ (বাচসাস) চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অন্য সংগঠনগুলোও শোক প্রকাশ করেছে। শোকের মাতম উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

এদিকে, আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা নাগাদ মরদেহ ঢাকায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন ফারুকের মেয়ে ফারিয়া তাবাসসুম পাঠান। সোমবার সিঙ্গাপুর থেকে ফারিয়া বলেন, ‘সব ঠিক থাকলে আমরা আগামীকাল (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৫টায় রওনা হব। হয়তো ৮টার মধ্যেই পৌঁছে যাব।’ ফারিয়া জানান, গাজীপুরের কালীগঞ্জ তুমালিয়া ইউনিয়নে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তার বাবার মরদেহ।

এদিকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার বলেন, ফারুকের মরদেহ মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছাবে। এরপর তাকে নেয়া হবে উত্তরার নিজ বাসায়। সকাল ১১টায় ফারুকের মরদেহ নেয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবে সর্বস্তরের মানুষ।

শহীদ মিনারে ঘণ্টাখানেক রাখার পর মরদেহ নেয়া হবে তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে। সেখানে চলচ্চিত্রের মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এ ছাড়া বাদ জোহর এফডিসি প্রাঙ্গণে অভিনেতার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বিকেলের দিকে ফারুকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তার নির্বাচনী এলাকা গুলশানের আজাদ মসজিদে। সেখানে বাদ আসর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে এবং এলাকার মানুষজন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। সবশেষে ফারুকের মরদেহ নেয়া হবে গাজীপুরের কালীগঞ্জে। সেখানে সন্ধ্যা ৭টায় তৃতীয় জানাজা শেষে পাঠান বাড়িতে তাকে সমাহিত করা হবে।

মূলত ২০১২ সালের জুলাইয়ে নায়ক ফারুক এক মাস ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফারুক দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগে ভুগছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট সিঙ্গাপুরে যান ও সেখানকার মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসা শেষে ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট আবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ খিঁচুনি হওয়ার পর তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। ১৮ মার্চ অবস্থার কিছুটা উন্নতির পর ২১ মার্চ আবার অচেতন হলে আইসিইউতে নেয়া হয়। এর পরপরই তাকে আবার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সেখানেই টানা চিকিৎসা শেষে সোমবার তিনি মারা যান।

আজীবন সম্মাননাসহ একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা ফারুকের জন্ম মানিকগঞ্জে। ১৯৭২ সালের এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক হয়। তার বিপরীতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন কবরী। এর পরে তিনি ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ নামে দুটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত সুজন সখী ও লাঠিয়াল নামে ব্যবসাসফল ও আলোচিত দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং সে বছর লাঠিয়াল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত তিনটি চলচ্চিত্র ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘মাটির মায়া’ ও ‘নয়নমণি’। চলচ্চিত্রটি তিনটি বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পরের বছর শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গালাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র দুটি নারীকেন্দ্রিক হলেও ফারুকের অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৭৯ সালের পর তার অভিনীত ‘নাগরদোলা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘কথা দিলাম’, ‘ঝিনুক মালা’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘এতিম’, ‘ঘরজামাই’, ‘সখী তুমি কার’সহ আরও বেশকিছু সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হন ফারুক। পরে ‘মিয়া ভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

নায়ক ফারুক অভিনীত আরও উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘দোস্তী’, ‘সোনার তরী’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘মাসুম’, ‘হাসু আমার হাসু’, ‘মায়ের আঁচল’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘পরীস্থান’, ‘সুদ আসল’, ‘জীবন সংসার’, ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘দাদী মা’ ইত্যাদি। ২০১৬ সালে ফারুক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘আজীবন সম্মাননায়’ ভূষিত হয়েছিলেন।

ফারুকের আরেকটি স্বপ্ন ছিলো নিজের গল্প ভাবনায় অন্তত একটি হলেও সিনেমা নির্মাণ করা। তিনি গল্প নিয়ে ভেবেছিলেনও। কিন্তু সেই স্বপ্নও অধরাই রয়ে গেলো। চলচ্চিত্রের বাইরে ফারুক একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। গাজীপুরে অবস্থিত নিজের শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘ফারুক নিটিং ডাইং অ্যান্ড মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। এদিকে রাজনীতিতে তিনি স্কুলজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময় তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ফারজানা পাঠানকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ফারুক। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। কন্যা ফারিয়া তাবাসসুম পাঠান ও পুত্র রওশন হোসেন।

Comments (0)
Add Comment