ঢাকা নিউ মার্কেট এলাকা রণক্ষেত্র : ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থী সংঘর্ষে একজন নিহত

টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা : পুলিশ ও সাংবাদিকসহ আহত দেড় শতাধিক
স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে রীতিমতো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো গতকাল মঙ্গলবার। এদিন সকাল ১০টার পর থেকে দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। যা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এর আগের দিন রাতে একটি খাবারের দোকানের কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বচসা হয়। এর জের ধরে মধ্যরাতেও হয়েছিলো টানা তিন ঘণ্টার সংঘর্ষ। এরপর সকাল ১০টার আগ পর্যন্ত গোটা এলাকা ছিল মানবশূন্যহীন ভূতুড়ে পরিবেশ। এরপর দুপক্ষের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, টায়ারে অগ্নিসংযোগ, লাঠি-রড হাতে ধাওয়া-পালটাধাওয়া এবং পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষে আহত একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি বয় নাহিদ হোসেন (২০) রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এছাড়া পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীসহ দেড়শতাধিক আহত হয়েছেন। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ একজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী ৫ মে পর্যন্ত ঢাকা কলেজের সব হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বলা হয়েছে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেছে শিক্ষার্থীরা। সোমবার রাতে পুলিশ সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেও মঙ্গলবার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে অনেক দেরিতে। এ কারণে অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাদের প্রশ্ন-রাতের এই সংঘর্ষ পরের দিন (মঙ্গলবার) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়াল কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতারা অথবা ঢাকা কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ ঘটনা দ্রুত থামাতে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিলেন না কেন? চলমান রমজানে প্রচ- গরম, সংঘর্ষে সৃষ্ট অসহনীয় যানজট মারিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। অনেকে এসেছিলেন আসন্ন ঈদুল ফিতরের কেনাকাটা করতে। দীঘস্থায়ী সংঘর্ষে রাস্তাঘাট বন্ধ থাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ প্রায় দুই বছর করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাও ঈদকে সামনে রেখে বেচাকেনা নিয়ে মহাব্যস্ত ছিলেন। এ সময় একেবারেই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন সংঘর্ষের ঘটনাটিকে নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। পুরো ঘটনার নির্মোহ অনুসন্ধান চালিয়ে এর দায় কার-তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ীদের আইনের মুখোমুখি করা হবে। এদিকে দুপুরের পর থেকে নিউমার্কেট এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ইডেন ও বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে ত্রিমুখী সংঘর্ষে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দেশীয় অস্ত্র, ইট-পাটকেল, লাঠিসোটা ও পুলিশের টিয়ার শেল এবং রাবার বুলেটের শব্দে পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। রাস্তায় মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বস্তু দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়া হচ্ছে আগুন। থমকে গেছে মিরপুর সড়কের যানবাহন চলাচল। এতে আশপাশের সড়কগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। যানজটে আটকা পড়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রোজাদার যাত্রীরা।
এদিকে সংঘর্ষে আহত হয়ে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) থাকা নাহিদ হাসান (১৮) নামে এক যুবক মারা গেছেন। তিনি এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগনাল এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল জরুরি বিভাগের ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন আইসিইউতে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. তৌফিক এলাহী।
অভিযোগ উঠেছে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল থেকে সংঘর্ষ শুরু হলেও দুপুরের আগে পুলিশের দেখা পাওয়া যায়নি। এর মধ্যেই সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ১৫০ জন আহত হয়েছেন। বিকেলে ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় নামে ইডেন কলেজের ছাত্রীরা। এ দিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সময়ের আগেই ঢাকা কলেজ ও হল বন্ধ ঘোষণা করে ঈদের ছুটি দেয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আজ বুধবার আবারো আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে সাত কলেজ আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ইসমাইল সম্রাট। পুলিশ কমিশনার বলেছেন, সব পরিস্থিতিতে গুলি করে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীদের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ কঠিন পর্যায়ে চলে গেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ দিকে বিকেলের পর থেকে নিউমার্কেট-ঢাকা কলেজ এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা নিয়ন্ত্রণ করেছে মোবাইল অপারেটরগুলো। তারা বলছে, নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি সিদ্ধান্তে এটা করা হচ্ছে।
যেভাবে ঘটনা শুরু: সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিউমার্কেটের একটি দোকানে পোশাক কিনতে যান ঢাকা কলেজের তিনজন শিক্ষার্থী। এ সময় পোশাকের দাম নিয়ে বিক্রেতাদের সাথে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় ওই পোশাক ব্যবসায়ী তিন শিক্ষার্থীকে আটক করে মারধর করে। পরে তারা ঢাকা কলেজের আবাসিক ছাত্রদের বিষয়টি জানালে রাতেই শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু সংঘর্ষ না থামায় পুলিশও লাঠিচার্জ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। পরে রাত সাড়ে ৩টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন পরদিন মঙ্গলবার মার্কেটের কোনো দোকান খুলতে দেয়া হবে না। সেই ঘোষণার সূত্র ধরে গতকাল সকাল থেকে পুনরায় চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। দেশীয় অস্ত্র ও ইটপাটকেল লাঠিসোটা নিয়ে এক গ্রুপ অপর গ্রুপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবার কৌশল অবলম্বন করে কোনো গ্রুপ পিছু হটে দূর থেকে ইট ছুড়তে থাকে। পর্যাপ্ত ইট ও লাঠি সংগ্রহ করে একত্র হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে চলতে থাকে কয়েক ঘণ্টা। উভয় পক্ষ বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মচারীরা মার্কেটের ছাদে এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাকা কলেজের একাডেমিক ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে ইট-পাটকেল ছুড়ছে। এর মধ্যে হাজির হয় হেলমেট বাহিনী। তারা হকিস্টিক ও গজারি কাঠ নিয়ে হামলা শুরু করে। খবর পেয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা সংবাদ সংগ্রহ করতে সেখানে উপস্থিত হলে ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পড়েন। সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। ব্যবসায়ীদের হাতে একে একে ৯জন সাংবাদিক মারাত্মকভাবে আহত হন। ব্যবসায়ীরা তাদের হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। আহত হয় আরো কমপেক্ষ ৫০ জন। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরও পুলিশের দেখা পাওয়া যাচ্ছিলো না। দুপুরের পর বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছেই মারমুখী অবস্থানে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গোটা ক্যাম্পাস। পুলিশ কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে টিয়ার শেল ও গুলি চালায় বলে ছাত্ররা অভিযোগ করেছে। বিকেল ৩টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলেও ঘণ্টাখানেক পর আবার শুরু হয় সংঘর্ষ।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ঈদের আগে জমজমাট ব্যবসার এই মরসুমে একদিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ক্ষতি দাঁড়াতে পারে শত কোটি টাকা। এত গেল অর্থের হিসাব। এই অঙ্ক নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু এই সংঘর্ষের কারণে যে নাগরিক ভোগান্তি হলো তার মূল্য নির্ধারণ হবে কিভাবে? ব্যবসায়ীদের অভিযোগ খাবারের দোকানে গিয়ে বিল না দেয়া বা কম দেয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। এ নিয়ে টুকটাক ঝামেলাও হয়। কিন্তু সুরাহা হয় না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নয়, এসব করেন প্রভাবশালী কোনো সংগঠনের আশীর্বাদপুষ্টরা। দোকানিদের সাথে বচসার মতো ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে এক জোট হয়ে হামলা চালানো সাধারণ কয়েকজন শিক্ষার্থীর পক্ষে যে সম্ভব নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন দ্বিতীয় দিনে সংঘর্ষ শুরু হলেও তার কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ উপস্থিত হয়েছে। পুলশ শুরু থেকে ভূমিকা রাখলে সংঘর্ষ দীর্ঘায়িত নাও হতে পারত। তবে পুলিশ রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান বলেছেন, ‘সকাল থেকে পুলিশ ছিল। যখন সময় হয়েছে পুলিশ তখনই অ্যাকশনে গেছে। তারা সময় বুঝেই গেছে। তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাননি ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এটি এম মইনুল হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’
শিক্ষামন্ত্রীর কলেজ ও হলবন্ধের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান: ছাত্র-ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, প্রায়ই দেখি ঢাকা কলেজ ও আশপাশের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীদের সাথে ছাত্রদের বাকবিত-া হয় এবং অনেক সময় তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। এটা খুবই দুঃখজনক। মন্ত্রী বলেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০ এপ্রিল ঈদের ছুটিতে বন্ধ হলেও ঢাকা কলেজে যেহেতু ক্লাসের পরিবেশ নেই তাই গতকাল থেকেই এই কলেজে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। আগামী ৫ মে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা কলেজও খোলা হবে। গতকাল বিকেলে চাঁদপুর সার্কিট হাউজে এক সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় আহত সব শিক্ষার্থী এবং অন্যদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দীপু মনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সকাল থেকে থাকলে হয়তো পরিস্থিতি আরেকটু ভালো হতে পারত। তবে তারাও চেষ্টা করেছেন, আমি ছাত্র-ব্যবসায়ী সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাই। সবার সহযোগিতা কামনা করে মন্ত্রী বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে উসকানি দিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি খারাপ করার একটা অপচেষ্টা চলছে। আমি ব্যবসায়ী-ছাত্র-শিক্ষকসহ সবার কাছে অনুরোধ করব কোনো প্রকার গুজবে কান দেবেন না। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হল ও ক্যাম্পাস বন্ধের মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, যেকোনো মূল্যে আবাসিক হল এবং ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন তারা। গতকাল বিকেল সোয়া ৪টায় ঢাকা কলেজের শহীদ আ ন ম নজিব উদ্দিন খান খুররম অডিটোরিয়ামে সম্মিলিতভাবে ছাত্রনেতারা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের কথা জানান।
এ সময় শিক্ষার্থীরা কলেজ অধ্যক্ষের অপসারণসহ ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনার বিচার দাবি করে সেøাগান দিতে থাকে। এর আগে আবাসিক হল বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্মআহ্বায়ক ফুয়াদ হাসান বলেন, প্রয়োজনে আমরা লাশ হয়ে বের হবো। তবু হল-ক্যাম্পাস ছাড়ব না। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশকে সাথে নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা চালানো হয়েছে এ ঘটনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
রাস্তায় নামলো ইডেনের ছাত্রীরা: নিউমার্কেটে ত্রিমুখী ঘটনায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সমর্থনে বিক্ষোভ-মিছিল করেছেন ইডেন কলেজের ছাত্রীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে জড়ো হন। এ সময় তারা উই ওয়ান্ট জাস্টিস, ঢাকা কলেজে হামলা কেন- ইত্যাদি সেøাগান দেন। পরে মিছিল নিয়ে নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা ধাওয়া দেন ছাত্রীদের। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এলে পিছু হটেন ব্যবসায়ীরা। ইডেন কলেজ সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্রী ঐশ্বর্য মালাকার বলেন, নিউ মার্কেটে কিছু কিনতে গেলে ব্যবসায়ীরা আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। যেকোনো বিপদে ঢাকা কলেজের ভাইয়েরা আমাদের জন্য এগিয়ে আসেন। তাই আজ তাদের বিপদেও আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। আমরা এ হামলার বিচার চাই।
সবার টার্গেট যেন সাংবাদিক: নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ৯ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন ইটের আঘাতে জখম হয়েছেন। এ ছাড়াও বেশ কয়েকজনকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়েছে হেলমেটধারীরা।
সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের সিনিয়র রিপোর্টার জসীম উদ্দীন মাহির চোখে এবং মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার ইকলাচুর রহমান হাতে আঘাত পেয়েছেন। এ ছাড়াও হেলমেটধারীরা দৈনিক আজকের পত্রিকার রিপোর্টার আল আমিন রাজু এবং ডেইলি স্টারের ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাসকে পিটিয়েছে। দীপ্ত টিভির রিপোর্টার আসিফ সুমিত, এসএ টিভির রিপোর্টার তুহিন, ক্যামেরাপারসন কবির হোসেন, আরটিভির ক্যামেরাপারসন সুমন দে, মাই টিভির রিপোর্টার ড্যানি ড্রং ইট ও হকিস্টিকের আঘাতে আহত হয়েছেন। কয়েকজন ব্যবসায়ী সাংবাদিকদের মারধর করার সময় চিৎকার করে বলতে থাকেন- ‘তোরা মিথ্যা খবর প্রচার করার জন্য আইসোস, যদি সত্য খবর প্রকাশ করতে পারিস তাহলে এখানে থাকবি, না হলে সব কটাকে পিটায়ে তাড়াব’।
এদিকে এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার সকালে আহতদের মধ্যে ৯ দোকান কর্মচারী ও শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা নেন। দোকান কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন, সাজ্জাদ (২৫), মো: সেলিম (৪২), মো: রাজু (১৬), মো: কাওছার আহমেদ (১৮), মো: আপেল (১৬), মো: সাগর (১৮), মো: রাসেল (১৫) ও মো: রাহাত (১৯) এবং ঢাকা কলেজ অ্যাকাউন্টিং বিভাগ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো: আলী (২২)।
গুলি করে নিউমার্কেটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বুদ্ধির কাজ নয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো: শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখানে বসে সবকিছু বোঝানো যাবে না। বাস্তবে সেখানকার ঘটনাটা জটিল অবস্থা ধারণ করেছে।’ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এ তথ্য জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। সচিবালয়ে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতি পর্যালোচনা নিয়ে সভা শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ সময় নিউমার্কেটের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে এ পরিস্থিতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা পুলিশ কমিশনারকে বলতে বললে মো: শফিকুল ইসলাম এ সব কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, টেকনিক্যাল কারণে ছাত্রদের সাথে পুলিশ সফট আচরণ করছে। সাধারণভাবে গুলি করে শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বুদ্ধির কাজ না। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের মোকাবেলা করার সময় আমাদের বেশকিছু সাবধানতা অবলম্বন করা লাগে। এটা সাধারণ কোনো গ্যাদারিং না যে গুলি করে তাদের সরিয়ে দিলাম। ছাত্ররা তাদের ১০ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করছে।’ পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের বুঝিয়ে মার্কেটে ঢোকানোর চেষ্টা করছি। আইজিপিও কথা বলেছেন ডিসির সাথে। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো একটা পক্ষকে নিবৃত্ত করা। কিন্তু আশপাশের সব শ্রমিক (ব্যবসায়ী) নেমে পড়েছেন। এখান থেকে ঘটনাটা যত সহজ মনে হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে তা জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। এখানে শুধু নিউমার্কেট না, চার পাশের সব মার্কেটের লোকজন বা শ্রমিক নেমে পড়েছেন, যেখান থেকেই খবর পাচ্ছি সেখানেই পুলিশ পাঠাচ্ছি। তিনি বলেন, শিগগিরই একটি সমাধানে পৌঁছুনো যাবে বলে আশা করা করছি।

Comments (0)
Add Comment