দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খুলে গেলো সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে দেশের বিস্ময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বপ্ন হলো সত্যি। গৌরব ও মর্যাদার তিলক নিয়ে এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। ষড়যন্ত্র আর প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে অদম্য সাহসিকতায় বাংলাদেশের নতুন পথ চলা শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনিঃশেষ আন্তরিকতা ও অমিত সাহস বাংলাদেশকে নিয়ে গেল সুউচ্চ এক মর্যাদার আসনে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার স্বপ্নের দুয়ার খুলে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার দুপুর ১২টায় পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে বাংলাদেশের বিস্ময় এ সেতুর উদ্বোধন করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেলিত হয় পুরো দেশ। দেশের মানুষ যেমন করে ১৯৭১ সালে একটি দন্ডে একাত্ম হয়েছিলো। তেমনি আবার এক সুতোয় বাঁধা পড়লো পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে। সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশকে যুক্ত করেছিলো নতুন এক প্রত্যাশার বুননে। পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অংশের সংযোগ ও যোগাযোগের এক অবারিত দ্বার উন্মুক্ত হলো। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে মাওয়া ও জাজিরা দুই প্রান্তেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান শুরু হয় মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশ দিয়ে। এরপর উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা এবং শিবচরের কাঁঠালবাড়িতে জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারযোগে রওনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সকাল ১০টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সুধী সমাবেশে যোগ দেন। তারপর শুরু হয় পদ্মা সেতুর ‘থিম সং’।

এদিকে উদ্বোধন উপলক্ষে সকাল ৯টার আগেই আমন্ত্রিত অতিথিরা মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। ১০টার আগেই আসন গ্রহণ করেন তারা। সুধী সমাবেশে জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সভাপতির বক্তব্য দেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর এবং পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

পরে প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম এবং বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করেন। এ সময় মঞ্চে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, ডাক সচিব খলিলুর রহমান এবং ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়জুল আজিম উপস্থিত ছিলেন। এরপর পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ টাকার বিশেষ স্মারক নোট উন্মোচন করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির উপস্থিত ছিলেন।

সেখান থেকে টোল প্লাজার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী। টোলপ্লাজায় টোল দিয়ে মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধনী ফলক, ম্যুরাল-১ উন্মোচন ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেন তিনি। এরপর উদ্বোধনী মঞ্চের বেদিতে বাটন চেপে বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। উদ্বোধনী বেদিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেলফি তোলেন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

এদিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে উপস্থিত ছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়া আবুল হোসেন। এছাড়া সুধী সমাবেশে দেয়া বক্তব্যের শুরুতে আবুল হোসেনসহ অন্যদেরও সহমর্মিতা জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রথম যাত্রী প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৫০ টাকা টোল দিয়ে গাড়ি নিয়ে প্রথম যাত্রী হিসেবে তিনি পদ্মা সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন। বেলা পৌনে ১২ টায় তার গাড়ি সেতুর টোল প্লাজার দিকে এগিয়ে যায়। দুই মিনিট পর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর টোল প্লাজায় পৌঁছায়। গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে টোলের টাকা দেন প্রধানমন্ত্রী। বহরে থাকা বাকি গাড়িগুলোর টোলও তিনিই পরিশোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার নিজের গাড়ি এবং বহরের সব গাড়ি মিলিয়ে মোট ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল দিয়েছেন। টোল  প্লাজায় দায়িত্বরত কর্মী ছিলেন তানিয়া আফরিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘টোল প্লাজায় একজন নারী ইনচার্জকে দায়িত্বে দেখে প্রধানমন্ত্রী খুব খুশি হয়েছেন। তিনি আমার নাম জানতে চেয়েছেন, আমার কেমন লাগছে জানতে চেয়েছেন। আমি আমার অনুভূতি ব্যক্ত করেছি, বলছি খুব ভালো লেগেছে। প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি দেখতে পেয়ে আমার স্বপ্নও পূরণ হলো।’ টোল দিয়ে বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে পদ্মা সেতুর দিকে এগিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। সেতুতে ওঠার আগে বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করেন তিনি। বাতাসে রঙিন আবির উড়িয়ে বর্ণিল পরিবেশে উদ্বোধন হয় বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর।

মাওয়া প্রান্তের ম্যুরাল চত্বরে উদ্বোধন শেষে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের উদ্দেশে যাত্রা করে শেখ হাসিনার গাড়িবহর। এ সময় মাঝ সেতুতে নেমে বিমানবাহিনীর বিমান ও হেলিকপ্টারের মনোজ্ঞ ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’ উপভোগ করেন তিনি। মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলও এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মনিরুজ্জামান হাওলাদারে নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান, পরিবহণ বিমান ও হেলিকপ্টারসহ মোট ২৮টি উড়ো যান এই ফ্লাইপাস্টে অংশগ্রহণ করে।

এই ফ্লাইপাস্টে মিগ-২৯ ও এফ-৭ সিরিজের যুদ্ধবিমান, সি-১৩০জে ও এল-৪১০ পরিবহণ বিমান, এবং গ্রোব-১২০ টিপি প্রশিক্ষণ বিমান বিভিন্ন ধরনের ফরমেশনে উড্ডয়নের পাশাপাশি বর্ণিল ধোঁয়া ছেড়ে অনুষ্ঠানস্থল অতিক্রম করে। জাতীয় পতাকা সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পদ্মা সেতু ও ‘জয় বাংলা’ ব্যানার নিয়ে এগিয়ে যায় পাঁচটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার।

এছাড়াও একটি বেল-২১২ হেলিকপ্টার থেকে অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের জন্য লিফলেট বিতরণ করা হয়। সবশেষে সাতটি কে-৮ডব্লিউ এবং একটি মিগ-২৯ বিমানের মনোমুগ্ধকর অ্যারোবেটিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে ফ্লাইপাস্ট শেষ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর ওপর প্রায় ১৪ মিনিট দাঁড়িয়ে বিমানবাহিনীর এই প্রদর্শনী দেখেন। পরে প্রধানমন্ত্রী গাড়িবহর নিয়ে পৌঁছান সেতুর জাজিরা প্রান্তে। সেখানেও উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করেন তিনি।

সমাবেশস্থলে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস: বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে অবস্থিত জনসভার মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘোষণা দেন, ‘পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতু পেরিয়ে জাজিরার দিকে আসছেন।’ এমন ঘোষণার পর জাজিরা ও শিবচর প্রান্তে থাকা লাখো জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তরুণেরা মিছিল করেন, বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ করতে থাকেন। আনন্দ মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত ও জাজিরার নাওডোবা প্রান্তের উদ্বোধন কার্যক্রম শেষে কাঁঠালবাড়ির জনসভাস্থলে পৌঁছান। এরপর মঞ্চে বাজানো হয় বাংলাদেশের লোকগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র শিল্পী আবদুল আলীমের ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’ গানটি। এরপর বাজানো হয় ‘ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে’ গানটি। এরপর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে জনসভাস্থল মুখরিত হয়ে ওঠে।

বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো কাঁঠালবাড়ি ঘাটে মঞ্চের ওপর দিয়ে চক্কর দেয়। এর একটিতে জাতীয় পতাকা, একটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত পতাকা, একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত পতাকা, একটিতে পদ্মা সেতুর ছবি সংবলিত পতাকা ও আরেকটিতে আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা বহন করা হয়। আরেকটি হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে জনসভায় আসা লোকজনকে অভিবাদন জানানো হয়।

এর আগে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সাধারণ মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সমাবেশস্থল। দক্ষিণের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসেন সেখানে। বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল চড়ে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন তারা। নানা রঙের টি-শার্ট পরে ঢাক, ঢোল ও বাঁশি বাজিয়ে সমাবেশে যোগ দেন তারা। সেতুতে মানুষের ঢল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেতুতে হাজার হাজার মানুষ হেঁটে বেড়িয়েছেন। উদ্বোধনের পরপরই মাওয়া প্রান্ত থেকে প্রথমে জনস্রোত সেতুতে ওঠে। হাজার হাজার জনতা পায়ে হেঁটে সেতুতে ঘুরে বেড়ান। কেউ কেউ মোটরসাইকেল নিয়েও সেতুতে ওঠেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জনতার কাউকে সেতুতে উঠতে বাধা প্রদান করতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ সেতুর পাশের সীমানা বেড়ার নিচ দিয়েও সেতুতে উঠতে দেখা গেছে। তবে ঘণ্টাখানেক পর সোয়া ২টার দিকে সেতু থেকে জনতাকে সরিয়ে নিতে দেখা যায়। ৩টার দিকে পুরো সেতু খালি হয়ে যায়। সেতুতে ওঠা একজন বলেন, ‘তিনি নারায়ণগঞ্জে থাকেন। তিনি পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখতে এসেছেন। কিন্তু উদ্বোধন অনুষ্ঠানস্থল থেকে অনেক দূরে তাদের আটকে দেয় নিরাপত্তা বাহিনী। পরে হেঁটে অনেক দূর থেকে পদ্মা সেতুতে এসে উঠেছেন।  শরীয়তপুর থেকে আসা মামুন বলেন, ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে ওঠে পড়েছি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। পদ্মা সেতু দেখে কিছু বলার আর ভাষা নেই। আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হলো।’

Comments (0)
Add Comment