স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ শুক্রবার সকালে ‘অতি প্রবল’ রূপ ধারণ করেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় এর জন্ম। ২৪ ঘণ্টায় এটি ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করে। ফলে এটি ক্রমেই বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। এ কারণে একদিনের মধ্যে ২ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত তুলে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ এই সংকেতের আওতায় থাকবে। এসব জেলার নিম্নাঞ্চলে ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। মোখার কারণে দেশের ৫ শিক্ষা বোর্ডের ১৪ মে রোববারে নির্ধারিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বোর্ডগুলো হচ্ছে-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, মাদরাসা এবং কারিগরি। জন্মের পর থেকে মোখা চরিত্র ও গতিপথ বদলাচ্ছে। প্রথমে কক্সবাজারের টেকনাফের ওপর দিয়ে মোখার কেন্দ্র বা চোখ অতিক্রম করার কথা বলেছিল দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থা। তবে শুক্রবার রাত ৮টায় এসব সংস্থার সর্বশেষ মডেলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূল অতিক্রমের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, রোববার সকাল ৬টা থেকে মোখার তা-বলীলা শুরু হয়ে যেতে পারে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে সন্ধ্যা ৬টার পর। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার হতে পারে। কিন্তু আজ শনিবার সন্ধ্যা থেকেই কক্সবাজার ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় মোখার অগ্রভাগের প্রভাব শুরু হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন মডেলে আরও দেখা যায়, উপকূল অতিক্রমের আগে আকস্মিকভাবে মোখার বাতাসের গতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। মোখার সঙ্গে থাকছে জলোচ্ছ্বাস, ভারি বৃষ্টিপাত, ঝড়ো হাওয়া এবং বজ্রসহ বৃষ্টি। ইতোমধ্যে দেশের আকাশ মেঘলা হয়ে গেছে। আজ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগর অস্থির হয়ে উঠেছে। মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার এবং সব ধরনের নৌযানকে সাগরে নামার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মোখার জন্ম হলেও এর অঙ্কুর হয়েছে মূলত গত শনিবার। আন্দামান সাগরে প্রথমে বাতাসের ঘূর্ণি-কু-লী সৃষ্টি হয়। পরে তা লঘুচাপ এবং সুস্পষ্ট লঘুচাপের পর্যায় পার হয়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আগে এটি কখনো দ্রুত পরের স্তরে পরিগ্রহ করে, আবার কখনো ধীরে আগায়। এছাড়া পরিস্থিতি স্থিতিশীলও ছিলো। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর এটি প্রথমে ঘণ্টায় ১২-১৩ কিলোমিটার ও পরে ৮ কিলোমিটার করে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে আগায়। পরে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক নেওয়ার পর এর গতি ফের ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার হয়েছে বলে জানায় ভারতীয় আবহাওয়া সংস্থা। অন্যদিকে মোখার কেন্দ্রের ব্যাস বাড়ছে। নিম্নচাপ থাকাকালে এর ব্যাস ছিলো ৪০ কিলোমিটার। পরে গভীর নিম্নচাপের সময় ব্যাস হয় ৪৮ কিলোমিটার। আর এখন এটি ৭৪ কিলোমিটার হয়ে গেছে। বিপরীত দিকে এর আকারও বাড়ছে। বর্তমানে পুরো ঘূর্ণিঝড়টির পরিধি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। ওদিকে রোববার সকালের দিকে উপকূলে পৌঁছানোর মাধ্যমে মোখা জন্মের পর ৭২-৭৫ ঘণ্টা সময় নেবে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড় যত বেশি সময় সাগরে অবস্থান করে, তা তত বেশি শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পায়। তাই শেষ পর্যন্ত কত গতিবেগে উপকূল অতিক্রম করবে সেটি নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না আবহাওয়াবিদরা। তবে তারা মনে করছেন, উপকূল অতিক্রমকালে এর দমকা হাওয়ার বেগ হতে পারে ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। ফলে স্থলভাগে যখন আছড়ে পড়বে, তখন এই ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা নিয়ে নানারকম আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ইতোমধ্যে গত বুধবারই সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, সুপার সাইক্লোন আকারে মোখা আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিচালক আবহাওয়াবিদ আজিজুর রহমান জানান, মোখার এখন পর্যন্ত যে অবস্থান, তাতে এটি রোববার দুপুরের দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। তবে সেটা বাংলাদেশের সীমানার বাইরে দিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এর গতিপথ পরিবর্তনও হতে পারে। শনিবার এ ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে। মোখার অগ্রভাগের প্রবেশের কারণে শনিবার সন্ধ্যার পর থেকেই উপকূল, বিশেষ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি হতে পারে। কক্সবাজার অঞ্চলে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে। আবহাওয়াবিদদের মতে, ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ যদি ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার হয়, তাকে সাধারণ ঘূর্ণিঝড় বা ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বলা হয়। গতিবেগ যদি ৮৯-১১৭ কিলোমিটার হয়, তখন তাকে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বা ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বলা হয়। আর বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১৮ থেকে ২১৯ কিলোমিটার হয়, তখন সেটিকে হারিকেনের গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ বলা হয়। ঝড়ের গতিবেগ ২২০ কিলোমিটার বা তার বেশি হলে তাকে ‘সুপার সাইক্লোন’ বলা হয়। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের ডান দিকে ঝড়ো হাওয়ার আঘাতটা বেশি থাকে। যেহেতু মোখার বাম দিকে থাকবে বাংলাদেশ, তাই এই যাত্রায় কম ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কোনো কারণে ঝড়টি ডানদিকে বাক নিলে তা গোটা কক্সবাজারকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে চলে যেতে পারে। তখন এটি ২০০৭ সালের সিডর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আবার বিদ্যমান গতিপথ অনুযায়ী, মোখা গভীর স্থল নিম্নচাপ আকারে বান্দরবান ও মিজোরামে নিঃশেষ হতে পারে। তখন এটি ব্যাপক বৃষ্টি ঝরাবে। ফলে বান্দরবান ও কক্সবাজারে বন্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও আছে। চেক আবহাওয়া সংক্রান্ত ওয়েবসাইট উইন্ডিডটকমের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, আজ মধ্যরাতের পরই সেন্টমার্টিনে আঘাত হানতে পারে মোখা। ওই দ্বীপটি ল-ভ- করে এগিয়ে যাবে মিয়ানমার উপকূলের দিকে। সেন্টমার্টিনে পৌঁছানোর আগে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার থাকতে পারে। কিন্তু উপকূলের ছোঁয়া পাওয়ার পর মোখার পেছনের দিকে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যেতে পারে। অথচ কয়েক বছর ধরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। উপকূলের কাছাকাছি আসার পর ঝড়গুলো শক্তি হারিয়েছিল। মোখা পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখছে বাংলাদেশ। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে বিএমডির জারি করা ১২ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হতে পারে। এতে আরও বলা হয়, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ আছে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। এছাড়া ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।