নিবন্ধন ফিরে পেলো জামায়াত

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। তবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক দাঁড়িপাল্লা বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন সংক্রান্ত যেকোনো অমীমাংসিত সমস্যা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় যদি থাকে, তার সাংবিধানিক আদেশ পূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। তবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক দাঁড়িপাল্লা থাকবে কিনা সে বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এরই মধ্যে প্রকাশিত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ নির্বাচন কমিশনে (ইসি) পাঠানো হয়েছে বলে জানান জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন এডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম। ২০১৩ সালের ১লা আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় (রুল অ্যাবসলিউট বা যথাযথ) দিয়েছিলেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। গতকাল আপিল বিভাগ তার রায়ে বলেছেন, রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তা ন্যায়সংগত হয়নি। গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও আদেশ বাতিল করা হলো।
ইসিকে পাঠানো রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে আপিল বিভাগ বলেন, আলোচিত তথ্য, পরিস্থিতি এবং আইনের প্রস্তাবনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি হাইকোর্ট বিভাগ এই বিধিটিকে নিরঙ্কুশ করার পক্ষে ছিল না। অতএব, ২০০৯ সালের ৬৩০ নং রিট পিটিশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ০১.০৮.২০১৩ তারিখের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায় এবং আদেশ বাতিল করা হলো। কারণ এটি মেইনটেইনেবল (রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য) ছিল না। তদানুসারে, পূর্বের স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করা হলো। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নিবন্ধন সংক্রান্ত যেকোনো অমীমাংসিত সমস্যা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় যদি থাকে, তার সাংবিধানিক আদেশ পূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়া হলো। ফলস্বরূপ, সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আপিলটি মঞ্জুর করা হলো এবং তদানুসারে, আপিলের অনুমতির জন্য দেওয়ানি আবেদনটি নিষ্পত্তি করা হলো। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবিলম্বে এই আদেশের একটি অগ্রিম অনুলিপি বিবাদীর নং ২৭- বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রেরণ করা হোক। বিস্তারিত রায় অনুসরণ করা হবে। জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অবশেষে নিবন্ধন ফিরে পেলো জামায়াতে ইসলামী। আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে এখন থেকে জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক দাঁড়িপাল্লা বহাল। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা মামলার মাধ্যমে দলটির নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এ রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক সংসদপ্রাপ্তি নিশ্চিত হলো। এ রায়ের পর বাংলাদেশে সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। এ ছাড়া জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বেছে নেবে বলেও আশা ব্যক্ত করেন এই আইনজীবী। নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। তবে রায়ে প্রতীকের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
চলতি বছরের ১২ই মার্চ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে আপিল শুনানি শুরু হয়। গত বছরের ২২শে অক্টোবর নিবন্ধন ফিরে পেতে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করে শুনানি হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে। জামায়াতের অপর আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক বলেন, আজকের রায়ের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন পুনর্বহাল হলো। দলটি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের জন্য ইসিতে আবেদন করবে বলেও জানান এই আইনজীবী।
২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়ার পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানান। রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭শে জানুয়ারি রুল জারি করেন। রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে ২০১০ সালে এবং ২০১২ সালে তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করাসহ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়। ২০১৩ সালের ১২ই জুন জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। এরপর, ২০১৩ সালে হাইকোর্টের ওই রায়ের পর দশম সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না।