ভারতীয় ধরনের সামাজিক বিস্তারের অশনি সংকেত!

মাথাভাঙ্গা মনিটর: মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও শুধুমাত্র ভারত থেকে প্রত্যাগত ও তাদের সংস্পর্শে আসা অতি স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) অস্তিত্ব মিললেও সম্প্রতি এতে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন এমন অনেকে ওই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হচ্ছেন, যারা সম্প্রতি ভারত ভ্রমণ করেননি এবং সেখান থেকে ফেরা কারো সংস্পর্শেও আসেননি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক বিস্তার বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে। যা করোনা পরিস্থিতির জন্য অশনি সংকেত বলছেন তারা।
তাদের ভাষ্য, দ্রুত এ ট্রান্সমিশন চেইন ভাঙতে না পারলেও ভারতের মতো বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়াবহ রূপ নেবে। তাদের চেয়ে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক দুর্বল হওয়ায়, তখন মহামারী পরিস্থিতি সামাল দেয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে দেশে ভারতীয় ডাবল মিউট্যান্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে করোনায় মৃত্যুর হার হু হু করে বাড়বে। দেশে গত ১৪ মাসে এ মরণ ব্যাধিতে যে সংখ্যক মানুষ মারা গেছে, আগামী কয়েক মাসেই সে সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়ার পর থেকে অদ্যাবধি সামাজিক সংক্রমণের চেইন ভাঙার জন্য কাগজে-কলমে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তার কোনোটিই সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বহুলাংশেই চিকিৎসা নির্ভর হয়ে আছে। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও এ প্রক্রিয়ায় করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। তাই শক্তিশালী ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে যে কোনো উপায়ে দ্রুত কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের চেইন ভাঙতে হবে। এ ক্ষেত্রে যতটা বিলম্ব ঘটবে, পরিস্থিতি ততই ভয়ঙ্কর হবে।
এদিকে দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরুর বিষয়টি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) নিশ্চিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরীক্ষিত নমুনার মধ্যে চার পঞ্চমাংশই করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট।
আইইডিসিআর জানায়, সপ্তাহ দুয়েক আগে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে করোনাভাইরাসের ৫০টি নমুনা সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪০টি নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। অথচ এই ৪০ জনের মধ্যে মাত্র ৮ জন সম্প্রতি ভারত ভ্রমণ করেছেন। বাকি ৩২ জনের মধ্যে ১৮ জনের বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ইতিহাস আছে। তবে ১৪ জনের দেশের বাইরে ভ্রমণ অথবা বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিতদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সামাজিক সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। আর এ তথ্য দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিশ্চিত করে বলে দাবি করে আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এটি খুবই আতঙ্কের বিষয়। কেননা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত সংক্রমণশীল। সরকারিভাবে আইইডিসিআর থেকে জিনোম সিকোয়েন্স করা হলে এটা আরও বাড়ানো দরকার বলে মত দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে ভারতের মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ভারতের ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এই ভ্যারিয়েন্ট একজন থেকে ৪শ জন পর্যন্ত মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তাই দেশে এই ভ্যারিয়েন্টটি ছড়িয়ে পড়লে তা সামাল দেয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ভারত ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আমাদের জন্য অনেক ঝুঁকির। এ ব্যাপারে আমরা বেশ আগে থেকে সতর্ক করছি। ভারত থেকে আসা যাত্রীদের সর্বোচ্চ কোয়ারেন্টিনের জন্য টেকনিক্যাল কমিটি সুপারিশ করেছে। কিন্তু আমরা সেটাও করতে ব্যর্থ হয়েছি।’
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে মানুষকে সঠিক তথ্য দেয়া জরুরি দাবি করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, সেটা সরকার এবং সাধারণ মানুষ-সবার জন্যই দরকার। কোথায় কোথায় এটা পাওয়া গেছে, সেটা জেনে সে হিসেবে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। তথ্য জানলে মানুষও সতর্ক হবে; নইলে অ্যাকশনে কাজ হবে না। প্রথম থেকেই দেখা গেছে, মানুষ ভয় পাবে এই যুক্তি দেখিয়ে অনেক তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। কিন্তু মানুষ ভয় না পেলে সতর্ক হবে না বলে যোগ করেন অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান।
এদিকে দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত পথগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পরও দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ শুরুর নেপথ্যে মূলত কী কারণ রয়েছে তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখার পাশাপাশি এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। তা না হলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। তারা সীমান্ত জেলাগুলো, বিশেষ করে যেসব এলাকায় এরইমধ্যে করোনা সংক্রমণের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে সেখানে দ্রুত কঠোর লকডাউন জারির তাগিদ দেন। একই সঙ্গে সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদারের সুপারিশ করেন তারা।

Comments (0)
Add Comment