সীতাকুণ্ডে কাদের অবহেলায় ঝরে গেল এতোগুলো প্রাণ

অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের দায় নিয়ে চলছে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোর আগুন ৪৪ ঘণ্টা পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। সোমবার সন্ধ্যায়ও ডিপোর বিভিন্ন কনটেইনার জ্বলতে দেখা গেছে। তবে আগুন আর ছড়ানোর সুযোগ নেই। ডিপোতে আরও ৪টি রাসায়নিকভর্তি কনটেইনার চিহ্নিত করা হয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য শনিবার রাত ১০টা থেকে সোমাবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টানা ৪৪ ঘণ্টা চেষ্টা চলছে। এ সময়ে ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব ভাউজার এবং আশপাশের ৭টি পুকুরের পানি ঢেলেও আগুন নেভানো যায়নি। ঘটনার দুদিন পরও ডিপোর পার্শ্ববর্তী কেশবপুর ও শীতলপুর গ্রামের মানুষের আতঙ্ক কাটছে না। গতকাল সোমবার ডিপোতে নতুন করে আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে ৪৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধারের কথা বলা হলেও সোমবার তা সংশোধন করা হয়। এদিন বলা হয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যদের পরিচয় নিশ্চিতে ৩৫ স্বজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ডিএনএ নমুনা।

এদিকে, সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের দায় নিয়ে চলছে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ। কেন এই অগ্নিকা-। কাদের অবহেলায় ঝরে গেছে এতোগুলো প্রাণ। কারা দায়ী এর পেছনে এসব প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। ডিপো কর্তৃপক্ষ বলছে ঘটনার পেছনে নাশকতা থাকতে পারে। তাদের দাবি যদি সত্য তাহলে কারা কেন এই নাশকতা করেছে এটিও এক বড় প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন এই ডিপোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। এইসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে সঠিক তথ্য না দেয়ায় প্রস্তুতি ঘাটতিতে সংস্থাটির কর্মীদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। বলা হচ্ছে কেমিক্যালের আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এতে প্রাণহানি বেড়েছে।

এছাড়া ওই ডিপোতে কেমিক্যাল রাখার অনুমোদনের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। এতো সব প্রশ্ন ও অভিযোগের মধ্যে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা এবং দায়ীদের শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি উঠেছে সর্বত্র। গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অবশ্য বলেছেন, তদন্তে যাদের দায় পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ওদিকে ডিপোর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি হাসপাতালে চলছে আগুনে পোড়া রোগী ও তাদের স্বজনদের হাহাকার। নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে পেতে এদিক-সেদিক ঘুরছে মানুষ। বাতাসে লাশের গন্ধ। আর সেই ডিপোর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কেমিক্যালের ড্রাম। এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে অনেক পণ্যবোঝাই কনটেইনার। এ যেন যুদ্ধপরবর্তী ধ্বংসস্তূপ। স্বাধীনতা পরবর্তী চট্টগ্রামের ইতিহাসে শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। আর এই প্রতিবেদন লেখার সময় সোমবার রাত ৮ টায়ও সেই তা-বলীলা থামেনি। বন্ধ হয়নি আগুন। এরপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত লাশ পাওয়া গেছে ৪১ জনের। যদিও রোববার রাতেই অর্ধশত মৃত্যুর কথা বলেছিল সিভিল সার্জন অফিস।

এদিকে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সামনে চলে এসেছে অনেকগুলো বিষয়। এই দুর্ঘটনার জন্য প্রথমত: ডিপো মালিক স্মার্ট গ্রুপের অবহেলাকেই দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, স্মার্ট গ্রুপ কর্মকর্তাদের তথ্য গোপন করার কারণেই এতোবড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর একটা কনটেইনারে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ডিপো কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। তবে কনটেইনারে যে কেমিক্যাল ছিল সেটা তখন ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জানানো হয়নি। যে কারণে তারা এসে স্বাভাবিক নিয়মে পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিল। এ সময় তাদের কাছে ছিল না বিশেষ কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরপর ৪০ মিনিটের মাথায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের তীব্রতা এতোই বেশি ছিল যে, আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা তীব্রভাবে কেঁপে ওঠে।

নন্দকানন ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের জানানো হয়েছিল গার্মেন্টস পোশাকের ডিপোতে আগুন লেগেছে। সেই হিসেবে আমরা অপ্রস্তুতভাবে আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। কেমিক্যাল থাকার কথা আমাদের জানানো হয়নি। ফলে আগুন নেভাতে যাওয়া প্রথম দলটি বিস্ফোরণের শিকার হয়েছে।

এদিকে ওই ডিপোতে ছিল না আগুন নিয়ন্ত্রণের বিশেষ কোনো ব্যবস্থা। ১০ হাজার কনটেইনার ধারণক্ষমতার এই ডিপোর লাইসেন্স নবায়ন করা নেই বলেও উঠেছে অভিযোগ। ডিপোর এমডি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় আইন-কানুনের তেমন তোয়াক্কা করতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও এই ঘটনার পর ডিপো কর্তৃপক্ষ নিহতদের জন্য ১০ লক্ষ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ঘটনার একদিন পর চট্টগ্রাম মেডিকেলে আহতদের দেখতে যান ডিপোর কর্মকর্তারা। তারা ফায়ার সার্ভিসের নিহত ও আহত কর্মীদের আর্থিক সহায়তা দেয়ারও ঘোষণা দেন।

মালিকপক্ষ বলছে, ফায়ার সার্ভিসকে ওই কনটেইনার ডিপোতে কেমিক্যাল থাকার কথা জানানো হয়েছিল। যদিও এখন তারা দোষারোপ করছেন। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না বলেও দাবি করেন তারা।

এই বিষয়ে বিএম ডিপোর পরিচালক ও স্মার্ট গ্রুপের এমডি মুজিবুর রহমান বলেন, অনেক কথাই বলার আছে। তবে এখন দোষারোপের সময় নয়। বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এটা অনেক দুঃখজনক। আমারও এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল। আমি এখান থেকে বের হবো কীভাবে।

এদিকে প্রথম থেকেই বলা হচ্ছিল, বিএম কনটেইনার ডিপোতে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের একটি চালান থেকেই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মাধ্যমেই এতোবড় বিস্ফোরণ হওয়ার কথা নয়। এটা হয় অন্য কোনো কারণে হয়েছে। এমনও হতে পারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সঙ্গে অন্য কোনো কেমিক্যাল বা দাহ্য পদার্থ ছিল।

বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিদর্শক মেহেদী ইসলাম খান মানবজমিনকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডে এতোবড় বিস্ফোরণ হওয়ার কথা নয়। এই যে ধরেন, আমরা যে ৬৪টি বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করি, সেখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের নামই নেই।’

এদিকে বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনাকে নাশকতা বলে দাবি করেছেন সীতাকুণ্ডের বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ। সোমবার বিকাল ৪টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে এসে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘ডিপোতে আট থেকে নয়শ’ কনটেইনার ছিল। কোনোটাই বিস্ফোরিত হয়নি। একটা কনটেইনারে কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে নাশকতার বিষয়টি স্পষ্ট।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, আমাদের ডিপো থেকে কোনো কনটেইনার বের করতে কিংবা প্রবেশ করাতে কাস্টমসের অনুমতি নিতে হয়। এখানে যদি কোনো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ থেকে থাকে তা কাস্টমস কর্মকর্তাদের জানার কথা।

এই বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং সাইনটিস্ট হিসেবে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষক ড. আবু আলী ইব্নে সিনা বলেন, হাইড্রোজেন পার- অক্সাইডকে প্রাথমিক ভাবে বিস্ফোরণের সূচনার জন্য চিহ্নিত করা হলেও বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুবই দুর্বল। আমি হার্ভার্ডের ল্যাবরেটরিতে কর্মরত বেশ কিছু গবেষকের সঙ্গে আলাপ করেও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। এই হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কোনো জৈব কেমিক্যালের সংস্পর্শে এলে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, নতুবা নয়। এই আগুন ও বিস্ফোরণের ধরন ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের নাশকতার প্রচেষ্টাও হতে পারে।’

এদিকে সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত রোগীদের দেখতে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, সীতাকুন্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় কয়েক ভাগে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। সে যত শক্তিশালীই হোক, ছাড় দেয়া হবে না।

Comments (0)
Add Comment