দেবীর বিসর্জনে সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রত্যয়

সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা
স্টাফ রিপোর্টার: কেউ কারও গালে, কেউবা কারও কপালে সিঁদুর ছুঁয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার আলতো ছোঁয়ায় প্রিয়জনকে রাঙাচ্ছেন লাল টুকটুকে সিঁদুরে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরসহ সারাদেশের পূজা মণ্ডপ গুলোতে এভাবেই সিঁদুর খেলায় মাতেন হিন্দু ধর্মের নারীরা। তবে বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ-উৎসবে রাশ টেনে ভক্তদের কাঁদিয়ে বিদায় নেন দেবী দুর্গা। শুক্রবারের বিকেলটা ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একই সঙ্গে আনন্দের ও বেদনার। শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিন শুক্রবার ছিল মহাদশমী। শেষ দিন র‌্যাব-পুলিশের কঠোর নিরাপত্তায় শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিমা বিসর্জনের পালা শেষ হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে মণ্ডপ থেকে প্রতিমা বের করা হয়। এর আগে মায়ের হাজারো ভক্তকুল মন্দিরে-ম-পে দিনভর তাদের ভক্তি জ্ঞাপন করেন। করোনামুক্তি, বিশ্ব-শান্তির সঙ্গে বাংলাদেশের হাজার বছরের গর্ব-ঐতিহ্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকার প্রার্থনা করা হয়। কামনা করা হয় সব অসুর শক্তির বিনাশ। এ সময় ভক্তরা দই ও খই ভোগ দেন। পরে আরতি ও অঞ্জলি, শেষে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি ঘটে এবারের দুর্গোৎসবের। বিজয়া দশমীতে দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের শেষ দিনে মণ্ডপে মণ্ডপে দশমীর বিহিত পূজার মধ্যদিয়ে ঘটে সমাপ্তি। অতপর দেবীর বিসর্জন আর শান্তিজল গ্রহণ। গত সোমবার বোধনে অরুণ আলোর অঞ্জলি নিয়ে আনন্দময়ী মা উমাদেবীর আগমন ঘটে মর্ত্যে। হিন্দু বিশ্বাসে-টানা পাঁচ দিন মৃন্ময়ীরূপে ম-পে ম-পে থেকে বিসর্জনের মধ্যদিয়ে ফিরে গেছেন কৈলাসে স্বামী শিবের সান্নিধ্যে। এক বছর পর নতুন শরতে আবার তিনি আসবেন ‘পিতৃগৃহে’। এবার ঘটকে আসা দেবী ফিরেছেন দোলায়। হিন্দুদের বিশ্বাসে, ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় ‘আনন্দময়ীর’ নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় যে উৎসবের সূচনা হয়েছিলো, দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনে তার সাঙ্গ হলো গতকাল শুক্রবার।
চুয়াডাঙ্গায় গতকাল শুক্রবার সকালে দর্পণ-বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। বেলা ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। এর মধ্যদিয়ে শেষ হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিসর্জনের মধ্যদিয়ে দেবী ফিরে গেলেন স্বর্গলোকের কৈলাসে স্বামীর ঘরে। পরের বছর শরতে আবার তিনি আসবেন এই ধরণীতে যা তার বাবার গৃহ। প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল শুক্রবার বেলা ৪টা থেকে চুয়াডাঙ্গা শিশুস্বর্গের পাশে মাথাভাঙ্গা নদীতে শুরু হয় বিসর্জন। চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার দুর্গামন্দির, দৌলাতদিয়ার দক্ষিণপাড়া বারোয়ারী দুর্গামন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরের প্রতিমা এখানে বির্সজন দেয়া হয়। ঢাকের বাদ্য আর গান-বাজনা ছাড়া বিদায়ের করুণ ছায়ায় সারিবদ্ধভাবে একে একে মাথাভাঙ্গা নদীতে বিসর্জন দেয়া হয় প্রতিমা। সড়কে পুলিশের টহল ও ফায়ার সার্ভিসের টিমও দায়িত্ব পালন করে।
সরোজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ এলাকায় সকল স্থানে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়েছে। সকলের বুকে ছিলো তাই বিসর্জনের বেদনা। প্রতিধ্বনিত হয় মা তুমি আবার এসো। এবার সরোজগঞ্জ এলাকায় ৭টি পূজাম-প তৈরি করা হয়। নজিরবিহীন পুলিশি প্রহরার মাধ্যমে পূজা অর্চনা সম্পন্ন হয়। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি কুতুবপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া, সিন্দুরিয়া, হাসনহাটি, আলিয়ারপুর ও পদ্মবিলা ইউনিয়নের ধুতুরহাট দাসপাড়া ও খেজুরা হালদার পাড়ার প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় নবগঙ্গা নদীতে, শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ কাচারিপাড়া প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয় চিত্রা নদীতে।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, কুমার নদের ভরা বুকে বিজয়া দশমীতে আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার সবগুলো এবং কালিদাসপুর গ্রামের প্রতিমা কুমার নদে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। বরাবরের মতন এ বিসর্জন উপলক্ষে কুমার নদের তীরে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ঢল নামে। সন্ধ্যার পর পর বিসর্জন দেয়া হয় সবকটি প্রতিমা। গতকাল শুক্রবার দেবী বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের পাঁচ দিনব্যাপী সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো।
বিসর্জনস্থল কুমার তীরেও পর্যাপ্ত পুলিশের উপস্থিতি ছিল। সন্ধ্যায় বিসর্জনের আগ মুহূর্তে শারদীয় দুর্গাপূজা বিসর্জনের ঘাট পরিদর্শন করেন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রনি আলম নূর, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল আনিসুজ্জামান, আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত তুহিনুজ্জামান, পুলিশ পরিদর্শক অপারেশন শেখ মাহবুবুর রহমান, কাউন্সিলর খন্দকার মজিবুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম স্বপন। পরে শারদীয় দুর্গাপূজা বিসর্জনের সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জেলা পূজা উদযাপন কমিটির যুগ্মসম্পাদক প্রশান্ত অধিকারী, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইয়াকুব আলী মাস্টার, উপজেলা তথ্য অফিসার সিগ্ধা দাস, পৌর কাউন্সিলর মতিয়ার রহমান ফারুক, আব্দুল গাফফার, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি ডা. অমল কুমার বিশ্বাস, সাংগঠনিক সম্পাদক নয়ন সরকার, পৌর সভাপতি পরিমল কুমার ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক জয় বিশ্বাস, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষেদের সভাপতি মনিন্দ্রনাথ দত্ত, সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সাধু খাঁ, পৌর সভাপতি লিপন বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক পলাশ আচার্য, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিজেস কুমার রামেকা।
কুড়–লগাছি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদার কুড়–লগাছি ইউনিয়নে ২টি কুড়–লগাছি বাজার ও চ-ীপুর পূজাম-পের প্রতিমা রায়সাবিলে ও কার্পাসডাঙ্গার আদিবাসীপাড়ার পূজাম-পের প্রতিমা ভৈরব এবং নাটুদার জগন্নাথপুর পূজাম-পের প্রতিমাও ভৈরব নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। কার্পাসডাঙ্গা ও কুড়–লগাছিতে এবং নাটুদায় দুর্গাপূজা চলাকালে আইনশৃংখলা রক্ষায় ভ্রাম্যমাণ পুলিশ টিম ও আনসার বাহিনী সার্বক্ষণিক এলাকায় টহল দিয়েছে। ফলে পূজানুষ্ঠানে শান্তি-শৃংখলা বজায়সহ কোনো প্রকার অপ্রিতীকর ঘটনা ঘটেনি।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে গতকাল শুক্রবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘শারদীয় দুর্গাপূজা’ শেষ হয়। তবে প্রাদুর্ভাব কমলেও করোনার কারণে এ বছরও বিজয়া দশমীতে সীমিত আকারে শোভাযাত্রা হয়। তবে চ-ীপাঠ, বোধন ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে ষষ্ঠ তিথিতে ‘আনন্দময়ীর’ আগমনে গত ১১ অক্টোবর থেকে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। পরবর্তী ৫দিন মেহেরপুর শহরসহ জেলার পূজাম-পগুলোতে পূজা-অর্চনার মধ্যদিয়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন। দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে তা শেষ হলো। দেবী দুর্গা এবার ঘোড়ায় চড়ে এসেছেন। গিয়েছেন পালকিতে চড়ে।
এদিন বিকেলের দিকে মেহেরপুর ভৈরব নদসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর-নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। মেহেরপুর শহরের পাঁচটি পূজামন্দির সহ মেহেরপুর জেলার মোট ৪২টি পূজাম-পের প্রতিমা স্ব-স্ব এলাকায় প্রদক্ষিণ শেষে বিসর্জন দেয়া হয়। এর আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা রঙ মেখে ও উলুধ্বনি দিয়ে প্রতিমা বিসর্জনে অংশগ্রহণ করেন। এভাবে শেষ হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে দেবী দুর্গা ফিরে গেলেন স্বর্গলোকের কৈলাসে স্বামীর ঘরে। পরের বছর শরতে আবার তিনি আসবেন এই ধরণীতে যা তার বাবার গৃহ। প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

Comments (0)
Add Comment