১৮৫ সিনেমার মহাতারকা শবনম, ২৫ বছর ধরে ভালো গল্পের অপেক্ষায়

ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম। প্রথম সিনেমা ‘হারানো দিন’ দিয়েই সাড়া ফেলেন তিনি। অভিষেক সিনেমাই ছিল সুপারহিট। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি গুণী এ অভিনেত্রীকে। এ সিনেমার ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি, ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’ গানটি আজও যেন দর্শকের মুখে মুখে। এই গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন এ অভিনেত্রী। মোস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত সিনেমাটি ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়।

ষাট দশক-নব্বই দশক পর্যন্ত পাকিস্তান আর বাংলাদেশে প্রায় ১৮৫টি সিনেমায় অভিনয় করেন শবনম। তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি পাকিস্তানি সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন টানা ১৩ বার। এ রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলিয়ে বহু সম্মাননায় সমৃদ্ধ হয় তার অর্জনের ঝুলি। দীর্ঘদিন তিনি পাকিস্তানের সিনেমায় অভিনয় করেছেন বলে অনেকেই মনে করতেন তিনি পাকিস্তানের নায়িকা। কিন্তু এ ধারণাও ভুল।

শবনমের আসল নাম ঝর্ণা বসাক। ১৯৪৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ক্যাপ্টেন এহতেশামের ‘চান্দা’ নামে একটি সিনেমায় ১৯৬২ সালে অভিনয় করেন তিনি। এই নির্মাতাই ‘হারানো দিন’ সিনেমায় তাকে শবনম নামটি দেন। শবনম নামের অর্থ হলো ‘ফুলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়া’। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন শবনম। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসাবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন।

১৯৮৮ সালে শবনম ঢাকা ও লাহোরের সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করতে থাকেন। নব্বই দশকের শেষভাগে ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সবশেষ তিনি অভিনয় করেছেন ‘আম্মাজান’ সিনেমায়। এ সিনেমায় নামভূমিকায় অভিনয় করে সব বয়সি দর্শকদের কাছে আম্মাজান হিসাবে পরিচিতি ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন। কাজী হায়াৎ পরিচালিত এ সিনেমাটি ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায়। এ প্রসঙ্গে শবনম বলেন, ‘আমার ভাগ্য ভালো যে, আমার অভিনীত প্রথম ও শেষ সিনেমা ছিল আমার ক্যারিয়ারের সেরা ও হিট সিনেমা।’

‘আম্মাজান’ সিনেমার পর শবনমকে আর ক্যামেরার সামনে দেখা যায়নি। তিনি বলেন ‘কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে এমন চরিত্র পাইনি বলেই অভিনয় থেকে দূরে সরেছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে উচ্চাসন দিয়েছেন সেখানে বসে গতানুগতিক চরিত্রে তো আর অভিনয় করতে পারি না।’ তবে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরেই তিনি ভালো গল্প ও চরিত্রের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর শবনম বিয়ে করেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষকে। ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন রবীণ ঘোষ। তাদের একমাত্র পুত্র রনি ঘোষ। বর্তমানে ঢাকায় নিজের বাসাতেই থাকেন শবনম। বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা ও ঘরের কাজকর্ম করেই এখন সময় কাটান। তিনি বলেন, ‘এখনো নিয়মিত বাজারে যাই, আমিই বাজার করি। বাজারে যাওয়ামাত্রই সবাই বলে, ওই যে আম্মাজান আসছেন। খুব ভালো লাগে আমার। অনেক সম্মানিত বোধ করি। আমার শিল্পীজীবনের বড় পাওয়া এটা।’ কাজ ছাড়া খুব একটা বাইরে বের হন না তিনি। বাসার বাজার করা ছাড়াও পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

জীবনের এ পর্যায়ে এসে কোনো না পাওয়া কিংবা চাওয়ার কিছু আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিনয় জীবনে অনেক পেয়েছি। তেমন কিছু চাওয়ার নেই। তবে যতদিন বাঁচি যেন সুস্থ থাকি এটাই প্রত্যাশা করি। এ জীবনে কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো ব্যথা নেই। অনেক পেয়েছি।’ তবে অভিনয়ের প্রতি এখনো আগ্রহ আছে। তিনি বলেন, ‘অভিনয়ই তো আমার পেশা। শিখেছি তো অভিনয়। অভিনয় করার ইচ্ছা আছে। তবে করতে না পারলে কোনো কষ্ট থাকবে না।’

শবনম অভিনীত সাদাকালো যুগের অনেক সিনেমার গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এখনো টেলিভিশনে সেসব সিনেমা প্রদর্শিত হয়। ইউটিউবেও দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার অভিনীত সিনেমা মাঝেমধ্যে দেখি। মনে পড়লে কিংবা দেখতে ইচ্ছে করলেই দেখি। ভালো লাগে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে। নস্টালজিক হয়ে পড়ি।’

বিদেশে অনেক বড় বড় সম্মাননা পেলেও নিজ দেশে বড় কোনো পুরস্কার এই শিল্পী পাননি। সেজন্য আফসোস কাজ করে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আফসোস কিংবা অতৃপ্তি নয়, দুঃখ কাজ করে। নিজের দেশে কিছু করতে পারলাম না।’