করুজ বাংলা মদ বোতলজাতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন দ্বিগুণ মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা : কার্যক্রম সফল করতে সব ধরণের প্রস্তুতি

দর্শনা অফিস: কেরুজ ডিস্টিলারি প্রতিষ্ঠার ৮৭ বছর পর বাংলা মদ বোতলজাত করণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ। মদের গুণগত মান অক্ষুণœ রাখতেই এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বেশ চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে অবশেষে সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসেছে কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বাজারজাত। এতে দ্বিগুনের বেশি মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ কার্যক্রম সফল করতে সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। অচিরেই স্থাপন করা হতে পারে বাংলা মদ বোতলজাতকরণ অটোমেশিন ও বোতল তৈরির কারখানা। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে পরিক্ষামূলকভাবে বোতলজাতকরণ করা হলেও বর্তমানে পুরোদমে চলছে এ কার্যক্রম। এ প্রক্রিয়ায় গুটি কয়েকজনের মুখ শুকালেই অনেকেই সন্তুষ্টচিত্রে দেখছেন বিষয়টি। বোতলজাতকরণ বন্ধে এক শ্রেণির কর্মকর্তা, শ্রমিক ও লাইসেন্সি উঠে পড়ে লেগেছে। একের পর এক বাধা সৃষ্টি করলেও দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। গাত্রদাহে নানা কৌশলে গোপনে বা প্রকাশ্যেই আইনি প্রক্রিয়াসহ নানা বাধায় প্রত্যক্ষ এবং পরক্ষ সহযোগিতাও করছেন এক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গুটি কয়েক সুবিধাভোগী কর্মকর্তা, বন্ডেড ওয়্যার হাউজের অ্যাজেন্ট ও লাইসেন্সিরা। গত বছরের ২৬ নভেম্বর একটি পরিপত্র জারি করে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রশাসন বিভাগ। এ বিভাগের পরিচালক (প্রশাসন অর্থ ও পরিকল্পনা) মোহাম্মদ মামুন মিয়া স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, দেশীয় মদ ১০০০ ও ৫০০ মি. লিটার বোতলে বাজারজাত করা হবে। এ বোতলে কেরুজ স্টিকার ও লেভেল সম্বলিত থাকবে। এতে উৎপাদিত মদের গুণগত মান থাকবে অক্ষুণœ। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের উচ্চতর একাধিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ৯ ডিসেম্বর বিএনএসিবব্লিউসি’র চেয়ারম্যান, সশস্ত্র বানিহী বিভাগের সভাপতি পিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এসএম কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে বৈঠকেও ড্রামে কেরুজ বাংলামদ বিকিনিকি স্বাস্থ্য ঝুকিপূর্ণ উল্লেখ্য করে দ্রুত কেরুজ বাংলা মদ বোতলজাতকরণের পূর্ণ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। সে মোতাবেক শুরু হয় কার্যক্রম। সারাদেশে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ১৩ টি সিএস’র (দেশি মদ) বন্ডেট ওয়্যার হাউজ রয়েছে। হাউজগুলো হচ্ছে দর্শনা, যশোর, খুলনা, পাবনা, পার্বতীপুর, শান্তাহার, ঢাকা, কুমিল্লা, শ্রীমঙ্গল, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল। যেখান থেকে বাংলা মদ লাইসেন্সধারী বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। এছাড়া ফরেণ লিকার (বিলেতি মদ) বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪টি। এ গুলো রয়েছে দর্শনা, ঢাকা, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারে।
জানা গেছে, বন্ডেড ওয়্যার হাউজের ইনচার্জ, সহকারী ইনচার্জ ও ওয়ার্কার হতে মরিয়া থাকতে দেখা গেছে শ্রমিক-কর্মচারীদের। কারণ ওয়্যার হাউজ ও বিক্রয় কেন্দ্রগুলো মানেই যেন টাকার পাহাড়। একেকটি হাউজের অ্যাজেন্ট হওয়ার সাথে সাথেই যেন তারা হাতে পেয়ে যান আলাদ্দিনের রূপ কথা গল্পের চেরাগ। যাতে ঘষা দিয়ে রাতারাতি বনে যাওয়া সম্ভব হয় আলিসান বাড়ি-গাড়ি ও ব্যাংক ভর্তি টাকার মালিক। যে কারণে হাউজের অ্যাজেন্ট (ইনচার্জ) হতে মরিয়া থাকেননা এমন কাউকে খুজে পাওয়া মুশকিল। এ্যাজেন্ট হতেই শুরু হয় টাকার লড়াই। ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দল, কেরুজ উচ্চ পর্যায়ের কর্তাবাবু ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি/সম্পাদকের দাড়স্থ হতে হয়। শুরু হয় দরকষাকষি। গুনতে হয় কাড়ি কাড়ি টাকা। এমনও হাউজ রয়েছে যেখানে পোস্টিং পেতে কোটি টাকাও গুনতে হয়েছে এ্যাজেন্টকে। এক দফাতে টাকা শেষ নয়। যতদিন যে এ্যাজেন্ট হাউজের ইনচার্জ হিসেবে থাকেন, তাকে মাসোহারা হিসেবে সোনার ডিম পৌছাতে হয়ে থাকে স্ব স্ব খাদকদের। হাউজ অ্যাজেন্টরা কেন বান্ডিল বান্ডিল টাকা কামাবেনা ? সে তথ্যে জানা গেছে, কেরুজ কর্তৃপক্ষ প্রতি প্রুপ লিটার সিএস (দেশি মদ) অ্যাজেন্টদের কাছে সরবরাহ করে থাকে ২২০ টাকায়। তাতে আফগারি শুল্ক ১২০ ও ৭.৫% ভ্যাট বাবদ পরিশোধ করা হয় ১৭ টাকা। ফলে ১ প্রুফ লিটারের মূল্য সর্বসাকুল্যে ৩৫৭ টাকা। উৎপাদনের স্টেঞ্জের তুলনায় বহুগুণে পানি মিশিয়ে তা ৩/৪ গুন বাড়িয়ে বিক্রি করা হয়ে থাকে লাইসেন্সিদের কাছে। ফলে লাভের অঙ্কটাও বেড়ে দাঁড়ায় বহুগুণে। এছাড়া লাইসেন্সধারী খুচরা দোকানিরা ৩৫৭ টাকা কিনে তাতেও পানি মিশিয়ে বিক্রি করে থাকে কমপেক্ষ সাড়ে ৫শ’ টাকা প্রতি প্রুফ লিটার। ফলে লাভের উপর লাভ।
সূত্রমতে, লাইসেন্সিরা চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে শতকরা ৬০% এলকোহল নির্ধারিত মূল্যে কিনলেও খোলা বাজারে যে মদ বিক্রি করে থাকে, তাতে এলকোহলের পরিমাণ থাকে শতকরা ৭/৮%। বোতলজাতকৃত বাংলা মদের প্রতি ১০০০ মিলিলিটারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে আফগারি শুল্ক সহ ৩১৯ টাকায়। যা লাইসেন্সিরা প্রতিবোতল ৫শ’ টাকা মূল্যে বিক্রি করলেও তাদের লাভ হবে ১৮১ টাকা। এ ছাড়া ৫০০ মিলিলিটারও আফগারি শুল্ক সহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৭ টাকা ৭০ পয়সা। এতে এলকোহলের পরিমান থাকছে শতকরা ৩৪%। ফলে লাইসেন্সিদের মুনাফা অর্জনের অংক অনেকটা কমলেও সুলভ মূল্যে সুবিধা ভোগ করতে পারবে ভোক্তারা। এ ছাড়া পাহাড়ি অঞ্চল শ্রীমঙ্গলের মূল্য আরও কম শুরু থেকেই। যে কারণে কেরুজ উৎপাদিত প্রকৃত গুণগতমান ক্ষুণœ হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশি মদ বর্তমানে প্রতি অর্থ বছরে ৫০/৬০ লাখ প্রুফ লিটার উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে বোতলজাতকরণ করা হলে এ মদের পরিমান বাড়বে বহুগুণে। সেক্ষত্রে একই দরে বিক্রি হলে কর্তৃপক্ষের তহবিলে জমা হবে অতিরিক্ত প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনের পরিমানও বাড়বে আগের তুলনা দেড় থেকে দুগুন। বোতলজাতকরণের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে লোকবল বৃদ্ধি করণে বাৎসরিক ব্যায় হতে পারে ১০/১২ কোটি টাকা, বোতল, কর্ক ও লেভেলে ১২/১৩ কোটি টাকা, ও হাউজগুলোতে পৌছে দিতে পরিবহন খরচ হবে ৯/১০ কোটি। সর্বসাকুল্যে অতিরিক্ত খরচের পরিমান দাড়াতে পারে ৩৮/৪০ কোটি কোটি। তবে সকল ব্যায় বাদ হিসেব করলেও ফি বছর কমপক্ষে ২শ’ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সম্ভবনা রয়েছে। মিলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেছে, দ্রুতই ডিস্টিলারির ফার্মাসিটিক্যাল ভবনে স্থাপন করা হতে পারে দেশি মদ বোতলজাতকরণের আধুনিক মেশিন ও বোতল তৈরির কারখানা। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত লোকবলেরো প্রয়োজন হবেনা।
সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশী মদ বোতলজাতকরণ অটোমেশিনের মূল্য অনুমানিক ৬ কোটি ও বোতল তৈরি কারখানায় খরচ হবে ১০ কোটি টাকা। তবে ওই কারখানায় ফরেণ লিকার (এফএল) ও দেশী মদ’র (সিএস) বোতল তৈরী হবে। ফলে বাইরে থেকে আর বোতল কিনতে হবে কেরুজ কর্তৃপক্ষকে। প্রতিটি ১০০০ মিঃ লিটার বোতল কর্ক সহ ক্রয় মূল্য ১৮ ও ৫০০ মিঃ লিটার সাড়ে ১৬ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।
কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশক্রমেই এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বাজারজাত শুরু হয়েছে বোতলজাতকৃত (দেশীয় মদ)। যার গুণগতমান থাকবে অক্ষুণœ। ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যেভাবে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, ঠিক সেভাবেই আমরা এগিয়ে চলছি। তবে বোতলজাতকরণ সিদ্ধান্তটি সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত। যাতে করে পণ্যের মান বাড়লে, বৃদ্ধি পাবে বিক্রি, আরও বেশি লাভবান হবে কেরুজ কমপ্লেক্সে। শুরু থেকে পরিপূর্ণভাবে বোতলজাতকৃত (দেশীয় মদ) হাউজ গুলোতে সরবরাহ করা সম্ভব না হলেও চলতি মাস থেকে পরিপূর্ণভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব ড্রামে সরবরাহ বন্ধ করা হবে। বর্তমান ২/১টি হাউজে ড্রামে সরবরাহ করা হলেও আগামি সপ্তাহখানেকের মধ্যে তা পরিপূর্ণভাবে বন্ধ করা হতে পারে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় কেরুজ কমপ্লেক্সের উন্নয়ন সহ অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষে আমরা কাজ করছি। সেক্ষেত্রে পিছু হটার কোন সুযোগ নেই। এ দিকে অনেকেই মন্তব্য করে বলেছেন, কেরুজ বাংলা মদ বোতলজাত করণের বিপক্ষে লড়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিকনেতা। শেষ পর্যন্ত ঠেকানো সম্ভব হলোনা। ফলে তাদের মুখ শুকিয়েছে। সেই সাথে কপাল পুড়তে শুরু করেছে হাউজগুলোর এ্যাজেন্টদেরও। বোতলজাতকরণ কার্যক্রম চলমান থাকলে শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন নির্বাচনের জৌলুস হারাবে। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচার দিন শেষ হবে ভোটের মাঠে। প্রতি রাতে সাংগঠনিক কার্যালয়ে ভূড়ি ভোজের প্রথাও হয়তো হারিয়ে যাবে তিমিরে। সাদামাটা পরিবেশে হতে পারে আগামি নির্বাচনগুলো। শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সম্বল হয়ে থাকবে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য।